তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয় কত?

আল-আমীন দেওয়ান, টেক শহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয় কত?-এমন প্রশ্নের উত্তরে বিতর্কহীন হিসাব বা পরিসংখ্যান মিলবে না কোথাও। এ খাত থেকে ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন এবং ২০২১ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা রয়েছে। আর নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান না থাকার কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ‘অনুমাননির্ভর’ ও ‘অসম্পূর্ণ’ তথ্য নিয়ে এগোচ্ছে খাতটি।

সরকারের এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয় ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সফটওয়্যার রপ্তানির হিসাব দিয়েছে ২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

অন্যদিকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০১৬ সালে রপ্তানির আয় ৭০ কোটি ডলার।

Techshohor Youtube

বেসিস সভাপতি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার টেকশহরডটকমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসেবে কম্পাইল করে তার রিপোর্ট আসে বাণিজ্যিক ব্যাংক বা সিডিউল ব্যাংক যেগুলোকে বলে তার মাধ্যমে। সিডিউল ব্যাংকগুলো যে ডেটা দেয় তা সি ফর্মের মাধ্যমে আসা অর্থের ।

সি ফর্ম শুধু ১০ হাজার ডলারের উপরে হলে পূরণ করতে হয়, নইলে করতে হয় না। ফলে ১০ হাজার ডলার উপরের রপ্তানির হিসাবটা সরকার পায়। এখানে ছোট ছোট ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রপ্তানিগুলো হিসেবে আসে না। কিন্তু ভলিউমে এগুলোই বেশি। ’

earn-online-techshohor

ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের এই সদস্য বলেন, ‘আরও অসংগতি আছে। যে সি ফর্ম হয় সেখানে মাত্র তিনটি ক্যাটাগরি রয়েছে। একটা ডেটা প্রসেসিং, একটি কনসালটেন্সি আরেকটা সফটওয়্যার। এখানে আইটি এনাবেল সার্ভিস, কল সেন্টারসসহ তথ্যপ্রযুক্তির অধিকাংশ ক্যাটাগরিই তো নাই।’

মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আসলে সফটওয়্যার রপ্তানি তো কম। সফটওয়্যার রপ্তানিতে এখনও সেই রকম সক্ষমতা অর্জিত হয়নি যে ইউরোপীয় সফটওয়্যার বিট করে বাংলাদেশের সফটওয়্যার রিপ্লেস করা যাচ্ছে। আমরা ব্যাপকহারে সার্ভিস রপ্তানি করছি, আমাদের সস্তা হিউম্যান রিসোর্স রয়েছে। আমরা যে কারণে গার্মেন্টস রপ্তানি করতে পারি সে কারণে আইটি সার্ভিস রপ্তানি করতে পারি। যার অর্থ হচ্ছে দেশের প্রধান রপ্তানি ক্যাটাগরিই তো রিপোর্টেড হয় না। তাহলে কী করে ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে নির্ভর করবো।’

কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়্যারের এই উদ্ভাবক পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব নিয়ে বলেন, ‘ব্যুরো যে হিসাব করে তা বাস্তবসম্মত নয়। তারা যে ডেটা দিয়েছে তা হলো কতগুলো প্রতিষ্ঠান ভিজিট করে তাদের কাছ হতে যা পেয়েছে তা। ব্যুরো এই কমিটির সঙ্গে বৈঠকে আমার প্রশ্ন ছিল এই ডেটার পরিধি নিয়ে।’

ICT

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কাউন্সিলর এই সদস্য বলেন, ‘রপ্তানির টাকাটা দেশে নিয়ে আসার পেছনে উৎসাহের বদলে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত দেশ হতে টাকা যদি বিদেশে খরচ করার জন্য নিতে চাই তাহলে ১০ শতাংশ এআইটি দিতে হয়। তাহলে যে টাকা বিদেশে খরচের প্রয়োজন হবে সেই টাকা তো কেউ দেশেই আনবে না।’

‘বড় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো বিদেশে অফিস রয়েছে, বিদেশে কার্যক্রমের ব্যপ্তি ঘটিয়েছে তারা টাকা সেখানেই রাখে। অথচ এই টাকা বাংলাদেশী কোম্পানি বাংলাদেশের শ্রমের টাকা। শুধু দেশের অফিস খরচ, অ্যাপ্লিয়িদের বেতন ছাড়া বাকী টাকা বিদেশেই রেখে দেন তারা। অনেকে ঝামেলা পোহাতে চান না। সি ফরমে না গিয়ে র‌্যামিট্যান্স হিসেবে টাকা নিয়ে আসে।’

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির চারবারের এই সভাপতি উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বন্ধ করা, গার্মেন্টসের টাকা আনতে যে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে সেই প্রণোদনা দেয়া, সি ফরমে হার্ডওয়্যঅর সফটওয়্যার ও আইটি এনাবেল সার্ভিস ক্যাটাগরি রাখা এবং ১০ হাজার ডলারের বার ভাঙ্গার কথা বলেন।

ICTD.techshohor

এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্ট এক বৈঠকে গত বৃহস্পতিবার তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘হয়তো রপ্তানি হলেও তার প্রমাণ থাকছে না। এটা লজ্জাজনক ব্যাপার।’

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছিলেন মোস্তাফা জব্বার, অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর শীতাংশু কুমার সুর চৌধুরী, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশীদ, বিসিসি নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার সরকার ও বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসান।

বৈঠকটিতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ : আইটি ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত সেবা (আইটিইএস) খাতে রপ্তানি সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক উপস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০১৬ সালের রপ্তানি ৭০ কোটি ডলার উল্লেখ করা হয়।

প্রতিমন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তব্যেও হিসেবের বাইরে আরও আয় হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করছেন।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে দারিদ্র্য কমানো ও মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের এই মডেল এখন বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত। জাতিসংঘ সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ কো-অপারেশন অ্যান্ড ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, অ্যাসিসিও ডিজিটাল গভর্মেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন সম্মানজনক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সে কথাই প্রমাণ করে।’

রপ্তানি আয়ের যে হিসাব অফিসিয়ালি বলা হচ্ছে তা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি বলে মনে করছেন প্রতিমন্ত্রী।

BASIS Logo-TechShohor

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ওই বৈঠকে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) রেফারেন্স তাদের খাতে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার রপ্তানির কথা বলা হয়।

তবে বাক্য’র সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ হোসেন টেকশহরডটকমকে বলেন, কল সেন্টার, ডাটা এন্ট্রিসহ বিভিন্ন সেবা রপ্তানি হয়ে থাকে। খাতটিতে আয় উল্লেখিত পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি।

ইবিপি ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, প্রচলিত বিধি-পদ্ধতির নির্দেশনা মেনেই তাঁরা আয়ের হিসাব করছেন। সরকারি নিয়মের মধ্যে যেসব খাত এই আওতায় পড়েছে তার হিসাব সঠিক রয়েছে।

বেসিস, বাক্যসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বেসরকারি শীর্ষ সংগঠনগুলো হিসাবে দেশে দেড় হাজার আইটি ও আইটিইএস কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের পাঁচশত কোম্পানি রপ্তানিতে রয়েছে।

শুধু বেসিসে ১০৮৬ সদস্য কোম্পানি রয়েছে । এরমধ্যে অর্ধেক কোম্পানিকে সক্রিয় হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

call center

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সংগঠনটির কাছে কোম্পানিগুলো ফর্ম পূরণ করে ২০১৪-২০১৫ সালের যে আয়ের হিসাব দিয়েছে তার মোট অংক ৫৯ কোটি ৪০ লাখ ৭৩ হাজার ডলার। এই রপ্তানি আয় ৩৮২টি কোম্পানির। কোম্পানিগুলো স্থানীয় বাজারেও আয় করেছ। তার পরিমান ২ কোটি ৭২ লাখ ডলার।

বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলছেন, আগে মোটিভেশনের অভাব ও নানা ভোগান্তির কথা কোম্পানিগুলো এই আয়ের হিসাব দিতে চাইতো না।

সংগঠনটির কাছে থাকা কোম্পানিগুলোর কাগজপত্রের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৩-২০১৪ সালের ২৭৭টি কোম্পানির রপ্তানি আয় ছিল ১৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৫ হাজার ডলার। ওই অর্থবছরে স্থানীয় বাজারে আয় ছিল ৮ কোটি ডলার।

এদিকে ইপিবির হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্য ছিল ১৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেখানে আয় হয়েছে ১৫ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার যা লক্ষ্যের চেয়ে ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি। আর ২০১৪-১৫ সালে এই আয় ছিল ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার।

আরও পড়ুন: 

*

*

আরও পড়ুন