![]() |
মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক : দ্বিতীয় প্রজন্মের লাইসেন্সের ১৫ বছরের একটা মেয়াদ পেরিয়ে আরও দুই বছর লেগেছিল তৃতীয় প্রজন্মের সেবা হাতে আসতে। আশা করছি, চতুর্থ প্রজন্মের সেবা বা ফোরজির জন্য আমাদের ততটা অপেক্ষা করতে হবে না। কতটা অপেক্ষা করতে হবে- সেই প্রশ্নের উত্তরও কি পাঞ্জেরির কাছে আছে?
ফররুখ আহমেদ পাঞ্জেরিকে এনেছিলেন রূপক অর্থে। যার কাছে ছিল কবির সব প্রশ্ন। রাত পোহাবার আর কতো দেরি পাঞ্জেরি- কবির এ জিজ্ঞাসা আজও অনেক জনপ্রিয়।
আমারাও তো পাঞ্জেরি ছাড়া আর কাউকে দেখছি না হাতের কাছে যাকে, ফোরজি বিষয়ক এ প্রশ্নটা করতে পারি। কতটা অপেক্ষা ও চাওয়ার পর আসবে ফোরজি?
পাশের দেশ মিয়ানমার, যারা কিনা মাত্র কয়েক বছর আগেও ছিল বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশের প্রকৃষ্ট উদাহারণ। যে কোনো বিষয়ের তালিকা হলে নিশ্চিতভাবে আমরা তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকতাম। আজ তথ্য প্রযুক্তির নানা সূচকেই আমরা তাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছি। তাদের মোবাইল গ্রাহকও এখন আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করছেন চতুর্থ প্রজন্মের সেবা। আর আমরা শান্তি খুঁজছি ডিজিটাল বাংলাদেশের ঢেকুরে।
অথচ এ মিয়ানমারেই কিনা মোবাইল টেলিফোনি সেবা এসেছে আমাদের ১৫ বছরের একটি মেয়াদ শেষ করার পরে! বিস্ময়কর, তাই নয় কি পাঞ্জেরি?
ইউরোপের দেশগুলো এখন মেতেছে ফাইভজি নিয়ে। ২০১৭ সালের মধ্যে কোনো কোনো দেশে চলে আসবে এ সেবা। এরপর ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপজুড়ে ফাইভজি’র সুবাস। কয়েক দিন আগে ইইউ কমিশন এ বিষয়ে যৌথ মেনিফেস্টও ঘোষণা করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপানের উদাহরণ দিতে চাই না। তারা ফাইভজির জন্য তৈরি। ভারত, পাকিস্তান-এমন কি ভুটানের চেয়েও যদি আমরা টেলিকম সেবায় পিছিয়ে পড়ি তাহলে এ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কার কাজে লাগবে?
টেলিযোগাযোগ খাতের নীতি নির্ধারকদের যার কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন, তিনিই বলবেন চলতি বছরের মধ্যে আসবে ফোরজি! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে?
এখনও স্পেকট্রাম, লাইসেন্স বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নীতিমালার খবর নেই। এমনকি সরকারি টেবিলগুলোতে চালাচালির জন্য একটি ফাইলও তৈরি হয়নি ফোরজি নিয়ে। তাহলে কিভাবে হবে? এর জবাব কারও কাছে নেই- যদিও বছরের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে পাঞ্জেরি।
দ্রুত ফোর জি চালুর বড় একটা সুযোগ আইন কাঠামোর মধ্যেই আছে। তৃতীয় প্রজন্মের স্পেকট্রামের নীতিমালার মধ্যেই চতুর্থ প্রজন্মের উল্লেখ আছে। এটাও বলা আছে, ২১০০ ব্যান্ডের ওই স্পেকট্রাম অপারেটরগুলো ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সেটা নিয়েই বেঁধেছে এক গোল।
বিদ্যমান তৃতীয় প্রজেন্মের প্রযুক্তি লাইসেন্সেই মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো চতুর্থ প্রজন্মের সেবা দিতে পারবে নাকি তাদেরকে নতুন করে লাইসেন্স নিতে হবে- সেটি নিশ্চিত করে বলছে না টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি।
জুনের এক কমিশন বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, যারা তৃতীয় প্রজন্মের লাইসেন্স পর্যালোচনা করে বলবেন ফোরজির জন্য নতুন লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি।
এরপর আসছে স্পেকট্রামের প্রশ্ন। অপারেটরগুলো চায় স্পেকট্রামের প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা- টেকনোলজিক্যাল নিউট্রালিটি। গোটা দুনিয়ার অধিকাংশ দেশে টেলিকম অপারেটরগুলো এ সুবিধা পায়, যা দিয়ে যে কোনো স্পেকট্রামে যে কোনো সেবা দেওয়া যাবে। এটি আসলে বড় বিনিয়োগের ঝক্কি কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। তখন সেবায় তারা বেশি বিনিয়োগ করতে পারে ও সেবার মানও হয় ভালো।
বিশ্বের বেশিরভাগ অপারেটর ১৮০০ ব্যান্ড ও ৯০০ ব্যান্ডে ফোরজি চালু করতে পেরেছে। অথচ আমাদের এখানে সেটা এখনও নিষিদ্ধ।
আমাদের দেশে সব সময় সরকারের মনযোগ স্পেকট্রাম থেকে কিভাবে নানা কায়দা কানুন করে বেশি টাকা আদায় করা যায়। সে কারণেই আগের স্পেকট্রামের যথোপযুক্ত ব্যবহার না হতেই সেটা অন্য সেবার জন্য নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। এখনও সেই চেষ্টা অব্যাহত। ফলে কাজীর গরু গোয়ালেই থেকে যায়, গ্রাহকের হাতে আর সেবাটা ঠিক মতো পৌঁছায় না। নামকাওয়াস্তে তখন সেবা আসে। তাতে গ্রাহকের সুবিধার সঙ্গে নতুন ভোগান্তিও তৈরি হয়।
সব সময় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, স্পেকট্রামের দামটা কম হলে তখন সেবার মান বাড়াতে তারা আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারবেন।
কয়েক দিন আগে কথা হলো চীনের এক প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানির শীর্ষ এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি পরিস্কার করেই বললেন, তাদের দেশের বা জাপান সরকারও স্পেকট্রাম থেকে আয় করতে চায় না। এটা জনগনের সম্পদ। জনগনের সেবাতে যেন তা কাজে লাগে এ হলো তাদের নীতি। বরং সেবা থেকে আয় বাড়িয়ে জনগণকে সুবিধা দেওয়ার নীতি তাদের।
এ খাত থেকে সরকারের আয় বাড়ানোর পদ্ধতি তো সেটিই হওয়া উচিৎ। তা ছাড়া আরও একটি যৌক্তিক প্রশ্নও আছে। টেলিকম থেকে সরকার আর কতটা আয় বাড়াতে চায়? এখনই তো গ্রাহকের একশ টাকার সেবা থেকে ২১ টাকা নিয়ে নিচ্ছে সরকার। অপারেটরগুলোর কাছ থেকেও তার ঢের পাচ্ছে। ফলে বছরে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা আসছে এ খাত থেকে। পাঞ্জেরির কাছে এ প্রশ্নও থাকছে।
টেলিকম বিশ্বের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত পাঁচশ’র বেশি অপারেটর ফোরজি সেবা দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে। দেশের হিসাব করতে গেলে তা দেড়শ’র বেশি হবে। প্রতিনিয়ত নতুন দেশ ও অপারেটরের নাম যোগ হচ্ছে এ তালিকায়। বাংলাদেশে এ সেবা পেতে আর কত রাত পোহানোর অপেক্ষা যে এখনও বাকি তা কি বলতে পারবে পাঞ্জেরি।
এখানে আরেকটা ফুটনোটও আছে। ফোরজি চালু করার ক্ষেত্র তৈরি হলেই যে সবাই নতুন এ প্রযুক্তিতে চলে আসবে তেমনটা ভাবার কারণ নেই। বিশ্বের যেখানে ফোরজি চালু হয়েছে, সেসব জায়গায় কিন্তু ফোরজির সঙ্গে থ্রিজি এমনকি টুজিও রয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে টেলিকমের বৈশিষ্ট্য।
আমাদের এখানেও ফোরজি চালু হলে প্রথমে প্রধানত বড় শহরগুলোতেই এ সেবা থাকবে। পরে হয়ত একটু একটু করে তা পেখম মেলবে, আওতা বাড়বে- যেমনটি হয়েছে থ্রিজির বেলাতে।
তিন বছর আগে দেশে থ্রিজি যাত্রা করলেও এমন সংযোগ সংখ্যা দেড় কোটির মতো। অথচ মোট ইন্টারনেট সংযোগ আছে ছয় কোটির বেশি।
লেখক : দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার। টেলিকম রিপোর্টারদের সংগঠন টিআরএনবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।