![]() |
মোস্তাফা জব্বার : ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল যখন কম্পিউটারের বোতামে হাত রাখি তখন এই যন্ত্রটি ছিল আমার হাতের কলমটার বিকল্প। সেটি দিয়ে বাংলা লিখে জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের অনুভূতির সন্ধান পেলাম। আস্তে আস্তে কম্পিউটার যন্ত্রটি তুলির বিকল্প, সিনেমা দেখার, ভিডিও সম্পাদনার, গান শোনার বা গেইম খেলার যন্ত্র হতে থাকে। তখন ওয়ার্ড স্টার, লোটাস ১২৩ ও ডিবেস-এর যুগ। আমি কখনও সাধারণ ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য কোথাও কম্পিউটার দেখতেও যেতাম না। ডসের নিটেক্স মনে রাখতে পারতাম না-তাই পিসি ছুঁয়েও দেখিনি। আমি তথ্যপ্রযুক্তি দেখতাম প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান; বাংলা বাজারে, পত্রিকা অফিসে বা বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ধীরে ধীরে অনুভব করলাম কম্পিউটারতো প্রচলিত সবই বদলে দিচ্ছে। সেই অনুভবকে বললাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরের চালের ফাঁক দিয়ে দেখলাম বিশাল এক আকাশ। ঘর থেকে পা বাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কি বিশাল সেই নীল। সামনের প্রান্তরের সবুজ আমাকে সীমাহীন সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দিলো।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিটি মানুষের কাছেই সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এক পরম সম্ভাবনার গল্প তৈরি করেছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন দেখার প্রায় সাড়ে সাত বছর পর কেমন জানি লাগছে। দেশ বদলাচ্ছে, সব কিছুই ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা আকাশ ভরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ডিজিটাল রূপান্তরে আমাদের স্বপ্নও বড় হবে -তাদের মাঝে এখন বিরাজ করে চরম হতাশা। খুব সহজ কথায় এর প্রধান কারণ দেশের ডিজিটাল রূপান্তরে আমরা স্বপ্নবাজেরা নিজেরা অংশ নেয়ার সুযোগ পাই না। খুব সত্যি কথা হচ্ছে, সরকারের বড় বড় ডিজিটাল রূপান্তরের কাজগুলো করছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা আন্তর্জাতিক টেন্ডারের নামে, টেন্ডারের শর্ত পূরণের নামে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের পুরো বাজারটাই দখল করে নিচ্ছে। কোথাও কোথাও দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সহযোগী, আংশিক কাজ করতে পারলেও আমরা আমাদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। ফলে বিশাল নীল আকাশটায় আমরা পাখা মেলতে পারিনা; বিদেশি কাক চিল শকুনে ভরে যাচ্ছে আমাদের আকাশ।
সরকার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। এই বছরেই বাজেটে ৬২২ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়েছে। এই অর্থের বিনিময়ে আমরা আমাদের ডিজিটাল যাত্রাকে আরও বেগবান করব। এজন্য আমরা সংগ্রহ করব কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার এবং সেবা। একদম সহজ সরলভাবে একটি কথা আমরা বলতে পারি যে, দেশে কম্পিউটার উৎপাদন বা সংযোজন না হবার ফলে আমাদের সকল হার্ডওয়্যার কেনাকাটায় বলা থাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কম্পিউটার হতে হবে। এই একটি শর্তই বাংলাদেশে উৎপাদিত বা সংযোজিত কোনো ডিজিটাল যন্ত্রকে সরকারী টেন্ডারে অংশ নিতে বাধাগ্রস্ত করে।
আমাদের দেশিয় পণ্য দোয়েল তো আর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নয় -তাই প্রথমেই দোয়েল বাদ। আমরা বিদেশি সফটওয়্যার কেনায় এত সিদ্ধহস্ত যে হাজার হাজার টাকায় নাম ধরে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম কিনি কিন্তু ভুলেও কোনো দেশি সফটওয়্যারকে যুক্ত করি না। এমনকি একশো টাকা দামের সফটওয়্যার না কিনেও আমরা অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার কিনি। সরকারের কেনা-কাটায় উইন্ডোজ অরিজিনাল সংস্করণ যদি থাকে তবে কম্পিউটারের জন্য আলাদাভাবে অ্যান্টি ভাইরাস সফটওয়্যার কেনার দরকার নেই। এটি উইন্ডোজের সঙ্গে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি কেনা হয়ই। আমি নিশ্চিত জানি যে, এই কেনাকাটার পেছনে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’।
এই বিষয়গুলো বহুদিন ধরে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাণিজ্য সংগঠন বেসিস আলোচনার টেবিলে এনেছে। বিসিএস বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। তার প্রধান কারণ আমরা বিদেশি পণ্যের পরিবেশক বা বিক্রেতা। ফলে দেশের উৎপাদন আমাদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। যদিও বাংলাদেশের ডেস্কটপ বাজার সংযোজিত কম্পিউটারের দখলে এবং ব্রান্ডের ডেস্কটপ কেবল সরকারই কিনে থাকে তবুও সরকারি কেনাকাটায় আমাদের ছোট বা মাঝারি বিক্রেতারা তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ও অন্যান্য শর্ত পূরণ করে অংশ নিতে পারে না। বেসিস বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা বলেছে। কিন্তু যতক্ষণ সরকারের কেনাকাটার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য কেনার বিষয়টি বিশেষায়িতভাবে দেখা না হবে ততদিন বিদ্যমান প্রচলিত ব্যবস্থা বদলাবে না।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিষয়গুলো নিয়ে এই নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। সকল সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে বিদেশি আগ্রাসন সমভাবেও নেই। আমরা আমাদের ইআরপি সফটওয়্যারের জগতে তেমন খারাপ অবস্থায় নেই। তবে এই খাতে বিদেশি আগ্রাসন যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু যেহেতু আমাদের মেধাজাত সম্পদ কারিগরি দিক থেকে উন্নত এবং আমাদের সঙ্গে বিদেশিরা দামে কুলিয়ে ওঠতে পারে না সেহেতু এর সিংহভাগ আমাদেরই দখলে। আমাদের বাংলা ভাষার সফটওয়্যার বাজারে বিদেশিরা সামান্যতম সুই প্রবেশ করাতে পারেনি। আমাদের শিক্ষামূলক ডিজিটাল কনটেন্টের ক্ষেত্রেও বিদেশিরা কোন আঁচড় কাটতে পারেনি।
ভয়ংকর অবস্থা বিরাজ করে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে। দেশের হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাঙ্ক ছাড়া বাকি সবাই শত শত কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকিং সফটওয়্যার কিনছে। এই কেনা-কাটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অভিযোগ আছে, সফটওয়্যার কেনার নামে এর কর্মকর্তা ও পরিচালকগণ শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও পাচার করছে। ব্যাংক খাতের এই তস্করদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় বা অন্যরা কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এসব অনাচার দেখেও না দেখার ভান করেছে সবাই।
সম্প্রতি দেশিয় এক সফটওয়্যার কোম্পানি বিদেশের শত কোটি টাকার বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে মাত্র ২ কোটি টাকায় ব্যাংকিং সফটওয়্যার দিয়েছে। ব্যাংক এশিয়া ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকসহ দেশের অনেকগুলো ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং এর কাজে এই দেশিয় কোম্পানির তৈরি করা সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালনা করা হয়। কোম্পানিটি মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংও করে। এমনকি তাদের রয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং সফটওয়্যার। এই প্রতিষ্ঠানটিকে দেখে মনে হলো, আমরা একদিন সকল কাজ আমাদের সন্তানদের তৈরি করা সফটওয়্যার দিয়েই করতে পারবো। বিদেশিদের প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলার সন্তানদের জন্য, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য।
প্রসঙ্গটি শেষ করার আগে সরাসরি কিছু প্রস্তাবনা পেশ করতে চাই।
প্রথমত: সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি কেনাকাটাকে আলু পটল কেনার মতো বিধিবিধান দিয়ে বন্দি না করে সরকারের উচিত তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সেবা সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষায়িত নীতিমালা প্রণয়ন করা। এই নীতিমালার প্রধান লক্ষ্য হবে দেশিয় পণ্য ও সেবা সংগ্রহ করা এবং দেশিয় পণ্য ও সেবা দিয়ে বিদেশি পণ্য ও সেবাকে প্রতিস্থাপিত করা। এজন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য এমন কঠোর আইন করা দরকার যে, দেশে যেসব হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার বা সেবা পাওয়া যাবে তা বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবে না। যদি আনতেই হয় তবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, আইসিটি মন্ত্রণালয়, বেসিস ও বিসিএস-এর যৌথ কমিটির অনুমোদন লাগবে এবং তার ওপর উচ্চহারে কর ও ভ্যাট দিতে হবে।
লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলামিস্ট। দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক। বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের প্রণেতা।
ই-মেইল : [email protected]
ওয়েবপেজ : www.bijoyekushe.net