![]() |
মর্ডান ই-লার্নিংয়ের জনক ড. বদরুল এইচ খান। ১৭ ভাষায় বিশ্বের পাঁচশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য তাঁর বই। প্রযুক্তির গবেষণায় নিমগ্ন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিক্ষাবিদ নিজের উদ্ভাবন ও স্বপ্নের কথা বলেছেন টেকশহরডটকমকে। সাক্ষাতকার আল-আমীন দেওয়ান।
‘দেশের জন্য সারাক্ষণ মনটা কেমন করে। যখন দেখি আমার উদ্ভাবন ব্যবহার করে উন্নত দেশ আরও উন্নত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে- অথচ পিছিয়ে রয়েছে আমার প্রিয় মাতৃভূমি-আমি খুব কষ্ট পাই’ এমনটিই বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে ওঠে তার।
এরপরও এক নাগাড়ে বলতে থাকেন তিনি। একান্ত আলাপচারিতায় বলেন, “বারবার ছুটে এসেছি দেশে, কিছু করতে চেয়েছি। কিন্তু দেশের নীতিনির্ধারকেরা কেন যেন বিষয়টি বুঝতে দেরি করলেন। আজও আমার আক্ষেপ হয়। সময় নষ্ট না করলে এক যুগ আগেই উন্নত বিশ্বের সমানতালেই চলে আসতো প্রিয় স্বদেশ।”
বুকের উপর হাত রেখে এভাবেই বলছিলেন ড.বদরুল এইচ খান। বিশ্বে মর্ডান ই-লার্নিংয়ের জনক বলা হয় তাঁকে। উন্নত দেশগুলোর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর তৈরি করা ই-লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ককে ভিত্তি ধরে চালু করেছে পিএইচডিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কোর্স।
গভীর হতাশা নিয়ে বর্ষীয়ান এ শিক্ষাবিদ বলেন, “আসলে সবকিছু অর্জন করে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ডিস ওয়াশ করে আমি পড়ালেখা করেছি। একটি টাকাও নষ্ট করিনি দেশের। আমার পায়ের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল একবার, টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারিনি।”
“আমার আজকের অবস্থান কোনো রাজনৈতিক সুপারিশে নয়, দেশের টাকায় নয়। আমি আমার মেধা দিয়ে, শ্রম দিয়ে,অধ্যাবসায় দিয়ে অর্জন করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেনশিপ আছে আমার, কিন্তু দেশের জন্য কিছু করতে ছুটে আসি বারবার। কোনো বিনিময় চাই না। আল্লাহ আমাকে যশ ও অর্থ দুটোই দিয়েছেন-টানা তিন ঘন্টার কথোপকথনে তিনি বলেছেন আরও অনেক কিছু।
কমনওয়েলথভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও এ শিক্ষাবিদ ই-লার্নিংয়ে পৃথক পরিকল্পনা দিয়েছেন। ন্যাটো ই-লার্নিং ফোরামও তার ফ্রেমওয়ার্ক ধরেই কাজ করছে। যেটির পরামর্শকও তিনি।
ই-লার্নিং নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘ওয়েব-বেইজড ইন্সট্রাকশন’ যুক্তরাষ্ট্রে বেস্ট সেলার। বইটি বিশ্বের প্রায় ৫ শত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক ও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ই-লার্নিংয়ে তাঁর বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের ১৭টি ভাষায়।
মিশরীয় ই-লার্নিং ইউনিভার্সিটি কাউন্সিলের অনারারি অধ্যাপক, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির সাবেক এ অধ্যাপক বাংলাদেশেরই কৃতি সন্তান।
শিক্ষায় প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা বিশ্বখ্যাত অ্যাসোসিয়েশন ফর এডুকেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির(এইসিটি) সাবেক এ সভাপতি ভার্চুয়াল এডুকেশনে হোয়াইট হাউজ অফিস অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসির (ওএসটিপি) একজন পরামর্শকও।
ই লার্নিং শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এডিবি, ইউএস ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট, শিক্ষা দপ্তরসহ বিভিন্ন বহুজাতিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তিনি।
সম্প্রতি ই-লার্নিং শিক্ষা পদ্ধতি এক সেমিনারে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। টেকশহরডটকমের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বর্ষীয়ান এ শিক্ষাবিদ কথা বলেছেন তাঁর উদ্ভাবন ও স্বপ্ন, ই-লার্নিংয়ের গুরুত্ব এবং ভাচুয়াল এ শিক্ষা পদ্বতিতে বিশ্বের এগিয়ে যাওয়া ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট নিয়ে।
টেকশহর : বিশ্ব সমাদৃত আপনার ই-লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক কি?
বদরুল এইচ খান : ই-লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক এমন একটি পরিপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষার মাধ্যম, সার্বজনীনতা, গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নৈতিকতাসহ সামগ্রিক বিষয়ের সমন্বয় রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ ফ্রেমওয়ার্ককে বেইজ করেই বিভিন্ন দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ই-লার্নিং শিক্ষাকে এগিয়ে নিচ্ছে।
টেকশহর : দেশে অনেকেই ই-লার্নিং বলতে ইন্টারনেটের শিক্ষা পদ্ধতিকেই বুঝে থাকে। আসলে এর পরিসর কতটুকু?
বদরুল এইচ খান : হ্যা, বিষয়টি অনেকের মধ্যে দেখেছি। এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। সমস্ত ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তিই ই-লার্নিংয়ে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, সিডিরমসহ নানা ডিভাইস হতে পারে এর মাধ্যম।
টেকশহর : প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ই-লার্নিং শিক্ষা পদ্ধতির মানগত কোনো পার্থক্য কি রয়েছে?
বদরুল এইচ খান : ই-লার্নিংয়ে একটা ব্যাপার রয়েছে যে নিজে শেখা। একজন শিক্ষার্থী তার পাঠে নিজে নিজেই আগ্রহী হয়ে থাকে, মনোযোগ তৈরি করে। এতে তার মস্তিস্কের চিন্তাশীল ক্ষেত্রের পরিসর বাড়ে।
শিক্ষার্থীর প্রতিযোগিতা তৈরি হয় শেখার সঙ্গে, সহপাঠির সঙ্গে নয়। দেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে যা একদম উল্টো। বেসিক মানের পার্থক্য এখানেই যে, ই-লার্নিংয়ের মূখ্য বিষয় শেখা।
এখানে একজন শিক্ষার্থী বিশ্বের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাৎক্ষণিক আপডেটগুলো পাচ্ছে এবং সেগুলোর আকর্ষণীয় উপস্থাপনা আরও কৌতুহলী ও আনন্দদায়ক পাঠদানের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
টেকশহর : বিশ্বজুড়েই শিক্ষা ব্যয় একটি আলোচিত বিষয়। সামর্থ্যের প্রশ্ন আছে সবসময়ই। ই-লার্নিংয়ে এ আলোচনা কি এমন বিতর্ক তৈরি করবে?
বদরুল এইচ খান : অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীর জন্য একেকজন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। পৃথিবীজুড়েই এই শিক্ষা ব্যয়ের বিতর্ক রয়েছে। তবে ই-লার্নিং ব্যয় সাশ্রয়ী। মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের বিপরীতে এটি শিক্ষাব্যয় কমিয়ে দেবে বহুগুন।
এতে লাগবে না ছাপাখানার পাঠ্যবই, লাগছে না ক্লাসরুম, লাগছে না ব্যাপক অবকাঠামো। এছাড়া এতে বহুগুন কমে আসবে প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে টিউশন ফি।
টেকশহর : আপনার উদ্ভাবন ব্যবহার করে অনেক দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা পিছিয়ে রইলাম কেন?
বদরুল এইচ খান : ২০০৪ সালে যখন বাংলাদেশে এসেছিলাম তখন এখানকার গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম প্রযুক্তি গ্রহণে দেরি করলে বা দ্বিধা করলে পিছিয়ে পড়ব আমরা। তখনও চেষ্টা করেছিলাম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে কিন্তু কেউ বিষয়টার গুরুত্ব বুঝলো না। দেশের জন্য কিছু করতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা দুঃখজনক।
টেকশহর : ২০০১ সালের মার্চ-এপ্রিলে আপনি দেশে এসেছিলেন একবার। তখনই আপনার প্রস্তুতি ছিল দেশে একটি বিশ্বমানের ভাচুর্য়াল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। আজ ১৪ বছর পেরিয়ে সেই স্বপ্নের কি মুক্তি হলো না?
বদরুল এইচ খান : আমার প্রস্তাবে আজ থেকে আরো ১১ বছর আগে ২০০৪ সালে দুবাইয়ে ভাচুর্য়াল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। সেখানে সম্পূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি পরিচালিত হচ্ছে ই- লার্নিংয়ে। অথচ নিজ দেশে ১৪ বছর চেষ্টা করেও বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বাস্তরে রূপ দিতে পারিনি।
ম্যাক ওয়েডন নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু জন্য সবকিছু প্রস্তুত। বর্তমানে এই ম্যাক ওয়েডন এডুকেশন থেকে বিশ্বে বেশ কিছু প্রোগ্রামও চালু আছে। শুধু অনুমতি পেলেই দেশের প্রথম ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারা পৃথিবীতে ই-লার্নিং পাঠদান পরিচালিত হবে।
টেকশহর : আপনার দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ই লার্নিংয়ের কোনো কার্যক্রম কি শুরু হয়েছে?
বদরুল এইচ খান : দেরিতে হলেও গত তিন বছরে বেশ কিছু কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সর্বপ্রথম ই লার্নিং প্লাটফর্ম হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য ই-লার্নিং প্লাটফর্মের মাধ্যমে আইসিটি কোর্স প্রবর্তন করছে।
এছাড়া আইসিডিডিআরবি’র ই-লার্নিং কার্যক্রমেও সহায়তা করছি। এটুআই আমার ফ্রেমওয়ার্কের উপর তাদের ই-লার্নিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমার পরামর্শ রয়েছে।
বর্তমানে তারা গুরুত্বের সাথেই ই-লার্নিং নিয়ে কাজ করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কাজ শুরু করেছে। আরো কিছু উদ্যোগ শুরু হতে দেখেছি যা আশাব্যাঞ্জক।
টেকশহর : বিশ্বের ১৭ টি ভাষায় আপনার বই রয়েছে। অথচ বাংলায় আপনার কোন বই নেই। কারণ জানতে চাই?
বদরুল এইচ খান : আরও ১৫ বছর আগে থেকেই আমি চেয়েছি বাংলায় অনুবাদ করার জন্য। কিন্তু কেউ আগ্রহই দেখালো না। তবে অবশেষে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাচ্ছি আমি। আশাকরি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলায় প্রথম বইটি প্রকাশিত হবে। এটুআইয়ের উদ্যোগে ‘ই শিক্ষা ও ই প্রশিক্ষণ’ নামে বইটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
টেকশহর : পিছিয়ে থেকে শুরুর পর এখন কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পাওয়া উচিত?
বদরুল এইচ খান : আমি ধরে নিচ্ছি আমাদের মানসিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে। তাহলে প্রথমেই উচিত হবে ই-লার্নিংয়ের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা । পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান রেখে ভিন্ন স্ট্যার্ন্ডাডের শিক্ষার্থীদের জন্য কনটেন্ট তৈরি করা। আমার ফ্রেমওয়ার্কতো আছেই। প্রয়োজ ভাচুর্য়াল শিক্ষার ব্লেন্ডেড লার্নিং, মিক্সড মোড টেকনোলজির প্রয়োগ।
এরপর ই-লার্নিং ফ্রেমওয়ার্কের উপর একটি পূনার্ঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্রুত অনুমোদন প্রয়োজন। যা অনেকখানি এগিয়ে দিতে পারে পুরো সিস্টেমকে।
টেকশহর : ই-লার্নিং ব্যবস্থায় বর্তমানে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত উপযোগিতা ঠিক কোথায় ?
বদরুল এইচ খান : এবার বাংলাদেশে এসে দেখলাম স্মার্টফোনে এক ধরণের বিপ্লব হয়ে গেছে। যেখানে অধিকাংশই ইন্টারনেটও ব্যবহার করছে। এখন এই ডিভাইসটিও ই-লার্নিংয়ের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। ই-লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক বেইজড করে এর উপযোগী কনটেন্ট ও সিস্টেম রান করা গেলে আধুনিক এই শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বকে চমকে দিতে পারে।