কয়েক প্রজন্ম মনে রাখবে এমন সিনেমা বানাতে হবে

Nafees_Photo_techshohor

অস্কারজয়ী প্রথম বাংলাদেশি নাফিস বিন যাফর। সফটওয়্যার প্রকৌশলী নাফিসের এটিই বড় পরিচয়। চার বছর পর দেশে এসেছেন তিনি। টেক শহরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে বলেছেন অনেক কথাই। সাক্ষাতকার নিয়েছেন তুহিন মাহমুদ।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নাফিস ২০০৭ সালে ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস এন্ড’ মুভিতে অ্যানিমেশন কাজের জন্য বিশ্ব চলচ্চিত্রের নোবেল খ্যাত অস্কার (একাডেমিক অ্যাওয়ার্ডস) জেতেন। সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল বিভাগে এ পুরষ্কার পান তিনি। বর্তমানে নাফিস লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক বিশ্বখ্যাত স্পেশাল ইফেক্টস ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ড্রিম ওয়ার্কস অ্যানিমেশনের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গত শুক্রবার ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে তিনি এক সেমিনারে অংশ নেন। পরে তিনি টেক শহরের সঙ্গে একান্ত এক সাক্ষাতকারে অংশ নেন। সেটিই এখানে তুলে ধরা হলো।

Techshohor Youtube

Nafees bin Zafar interview_TechShohor

টেক শহর : আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি একটু বলেন?
নাফিস : আমি ১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা জাফর বিন বাশার বর্তমানে নিউইয়র্কে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে কর্মরত। আর মা নাফিসা জাফর গৃহিনী। আমার দাদা বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কাজীকান্দা। নানাবাড়ী বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানার রামপারা। বাবার চাকরি করার সুবাদে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বেড়ে উঠেছি। শৈশবে ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হই। দেশে থাকার সময় মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজেস্ট্যান্ডার্ড সিক্স শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি । বাবার এমবিএ পড়ার সুবাদে ১১ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটনে চলে যাই আমরা। সেখানে কলেজ অব চার্লসটন থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি।

টেক শহর : কতদিন পর দেশে আসলেন?
নাফিস: প্রায় চার বছর পর। মূলত পরিবারের সাথে সময় কাটানো এবং প্রিয়জনদের দেখতেই এসেছি।

টেক শহর : কেমন লাগছে দেশে এসে?
নাফিস : অস্কার পাওয়ার পর আরও দু’বার দেশে এসেছিলাম। কিন্তু তখন মানুষের কাছ থেকে এবারের মতো এত সাড়া পাইনি। তাই সত্যিই ভালো লাগছে।

টেক শহর : কোন কাজের জন্য অস্কার পেয়েছিলেন?
নাফিস : ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস এন্ড’ মুভিতে ফ্লুইড ইফেক্ট যেমন পানি, ঢেউ, জাহাজ বা অন্যান্য জিনিস ভেঙ্গে যাওয়া বিষয়গুলো অ্যানিমেশনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার কারণে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

টেক শহর : আপনারা তিন জন এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখনও কি একই সঙ্গে কাজ করছেন?
নাফিস : হ্যাঁ, আমরা তিন জনই ভালো কিছু করতে পেরেছিলাম বলে সবাইকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এখন সবাই আলাদা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। আমরা খুব ভালো বন্ধু। তাই নিয়মিত যোগাযোগ হয়।

টেক শহর : বর্তমানে কি নিয়ে কাজ করছেন?
নাফিস: চলতি বছরের মাঝামাছি সময়ে মুক্তি পেয়েছে দ্য ক্রুড ও টগো সিনেমা। বর্তমানে হলিউডের দুটি ছবি নিয়ে কাজ করছি। দুটি ছবিই মাঝ পথে আছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি মুক্তি পাবে। প্রথমে মি. পি-বডি অ্যান্ড সারম্যান এবং পরে হাউ টু ট্রেইন ইউর ড্রাগন টু। এটা আসবে আগামী গ্রীষ্মে। তাই এখন অনেকটা ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।

Nafees bin zafar with parents-TechShohor

টেক শহর : আপনার করা অ্যানিমেশনের কতটি সিনেমা প্রকাশ পেয়েছে?
নাফিস : কাজগুলো আমরা অনেকে মিলে করি। এগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়ে থাকে। তাই এই সংখ্যাটা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে তা শতাধিক হতে পারে। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে- কুং ফু পান্ডা২, ২০১২, পার্সি জ্যাকসন অ্যান্ড অলিম্পিয়ান্স : দ্য লাইটিং থিফ, দ্য সিকার : দ্য ডার্ক ইজ রাইজিং, শ্রেক ফরএভার আফটার, স্টিলথ, মেগামাইন্ড প্রভৃতি।

টেক শহর : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
নাফিস : সত্যি কথা বলতে কি, আমার বাংলাদেশি সিনেমা দেখা হয় না। শুনেছি বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিল্ম শুরু হয়েছে। এটি অবশ্যই ভালো। উন্নত বিশ্ব কি করছে সেটি লক্ষ্য করে এগোলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এগিয়ে যাবে। পরবর্তী কয়েক জেনারেশন মনে রাখবে এমন সব সিনেমা তৈরি করতে হবে। বিশ্বের অনেক ভালো সিনেমা রয়েছে যেগুলো অর্ধশতক বছর আগের। এগুলো এখনও অনেকেই দেখে।

টেক শহর : সফটওয়্যার প্রকৌশলী হয়েও চলচ্চিত্রে কাজ করছেন কেন?
নাফিস : মূলত আমার পরিবারের অনেকেই শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। আমার নানা বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার। তার কাছ থেকে অনেক অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তাই ছোটবেলা থেকেই ক্রিয়েটিভ কিছু করতে মন চাইত। আমি যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করি তখন ছিল ‘ডটকম’ এর শ্রেষ্ঠ সময়। ক্রিয়েটিভ দিকটা ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পাওয়ায় যোগ দিলাম চলচ্চিত্র শিল্পে। এখন মনে করি সেটি ভাল সিদ্ধান্ত ছিল।

টেক শহর : বাংলাদেশ নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
নাফিস : এখন পর্যন্ত সে রকম করে কিছু ভাবা হয়নি। তবে আমি ব্যবসা করতে চাই না। কারণ আমি ভালো ব্যবসায়ী নই। আমি কাজ করতে ভালোবাসি। তাই যেখানে কাজের সুযোগ রয়েছে সেখানেই থাকতে চাই।

তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের প্রশিক্ষণ দিতে কিংবা সেমিনারে অংশ নিতে ডাকা হলে অবশ্যই আসব।

টেক শহর : আপনার এত সাফল্যের পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি? কাকে আইডল হিসেবে দেখেন?
নাফিস : আসলে আমার পরিবারের সবাই আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। নানার কথা আগেই বলেছি। আর মামা সৈয়দ মইনুল হোসেন জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি। পরিবারের সবাই মোটামুটি আঁকাআঁকিতে পটু। ছোটবেলা থেকেই তাদের কাজ দেখে আসছি। তাদের মতো বিখ্যাত হতে হবে এমন ভাবনা কখনও মাথায় আসেনি। তবে তাদের কাজ দেখতে দেখতে হয়ত অবচেতনভাবে তারা আমার ভেতরে জায়গা করে নিয়েছেন। আমাকে প্রভাবিত করেছেন। আমার বাবা ৪০ বছর বয়সে নতুন চাকুরি নিয়েও অনেক সাফল্য দেখিয়েছেন। এসব থেকেই আমার ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা আসে। আইডল হিসেবে ধরলে আমি আমার মায়ের কথাই বলব। তার অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় আমি এতদুর এসেছি।

টেক শহর : আপনার পছন্দগুলো কি কি?
নাফিস : কাজ নিয়ে পড়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসি। অ্যানিমেশনের সঙ্গে খেলা করি। মনে করি, আরও বেশি সময় দিতে পারলে আরও ভালো করতে পারতাম। তাই সব পছন্দ কাজকে ঘিরেই।

টেক শহর : অ্যানিমেশনে ভাল করতে হলে কিভাবে শুরু করা উচিত?
নাফিস : আসলে যাই করতে চান না কেন-সেজন্য আপনাকে সময় দিতে হবে। আগে বিষয়টি নির্বাচন করুন। তারপর ওই বিষয়ের বেসিক থেকে শুরু করতে হবে। আর অ্যানিমেশন ও স্পেশাল ইফেক্ট একটি ক্রিয়েটিভ কাজ। এ ক্ষেত্রে সফলতা আসতে অনেক সময় লাগে। আমি মনে করি, একজন অ্যানিমেটর হতে হলে কমপক্ষে ১০ হাজার ঘন্টা কাজ করতে হবে। তারপরেও বিভিন্ন সফটওয়্যার, প্রযুক্তির সাথে আপডেটেড থাকতে হবে।

pirate of the caribbean at world's end-TechShohor

টেক শহর : আগামীর পরিকল্পনা কি?
নাফিস : আরও ভালো করতে চাই এটাই মূল ভাবনা। বর্তমানে একটি সিনেমা শেষ করতে ৩০০ জনের অন্তত ৩ বছর সময় লাগে। অথচ সিনেমার শুটিং করতে সময় লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৪৫ দিন। আর বাকিটা লাগে স্টুডিওতে। এ সময়টা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সে নিয়ে কাজ করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছি।

টেক শহর : নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি?
নাফিস : না। আমি আগেও বলেছি আমি ব্যবসা ভালো বুঝি না। তাই নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান দেওয়ার ইচ্ছা নেই।

টেক শহর : পছন্দের পোশাক ও খাবার সম্পর্কে একটু বলুন?
নাফিস : আমি ট্রাউজার ও টি-শার্ট পরতে পছন্দ করি। খাবারের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ ভাত। বাঙ্গালী খাবারের পাশাপাশি যে কোনো সুস্বাদু খাবারই পছন্দ করি।

*

*

আরও পড়ুন