![]() |
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বড় সমস্যা – কর্মসংস্থানের অভাব। এ সমস্যার ভালো সমাধান, আত্মকর্মসংস্থান। যাঁরা উদ্যোক্তা তারা কেবল নিজের দায় নেন না, তাঁরা সমাজের দায়ও কাধে নেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনো জাতির প্রতি দায়িত্ববান উদ্যোক্তা বেশি তৈরি হয়নি। পরিবর্তে এক ধরণের সুবিধাবাদী ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছে বেশি। তাই উদ্যোক্তা তৈরি করতে ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল ফেইসবুকে ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ (https://facebook.com/groups/uddokta/) গ্রুপ খোলা হয়। ‘পথে নামলেই কেবল পথ চেনা যায়’ স্লোগান সামনে রেখে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ হাতে নেয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা বিডিওএসএনের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। তার সঙ্গে কথা বলে গ্রুপটির অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ নিয়ে লিখেছেন টেক শহর স্টাফ কনটেন্ট কাউন্সিলর -তুহিন মাহমুদ
শুরু যেভাবে
বাংলাদেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে বেশি অংশ তরুন। তবে, তাদের নিয়ে ভাবনা চিন্তা আসলেই কম। প্রতিবছর প্রায় ২১ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১১ লাখের কর্মসংস্থান হয়। বাকীদের থাকতে হয় বেকার। তাইওয়ান, জাপান কিংবা আরো অনেক দেশ এই সমস্যার সমাধান করেছে আত্বকর্মসংস্থানকে প্রমোট করে। ঘরে ঘরে উদ্যোক্তা বানানোর একটা চেষ্টা তাদের ছিল, আছে। তাইওয়ানের ৮৭ শতাংশ চাকরি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। মুনির হাসান টেক শহরকে বলেন “বছর কয়েক কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করার সময় দেখলাম একটি বড় গ্রুপ ৫০ বছরে ৪৫ হাজার পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে সেই পরিবারের লোকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, কেবল ফ্রিল্যান্সিংকে প্রমোট করে দেখি তিন বছরে ৩০ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। তার মানে, বড় শিল্পদ্যোগগুলোর পাশাপাশি যদি ছোট ছোট উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে ৫০ বছরে ৪৫ হাজারের যে সংখ্যা সেটিকে কয়েকগুন বাড়িয়ে ফেলা যায়।
তিনি আরো বলেন, “আমাদের দেশে আত্মকর্মসংস্থানকে তেমনভাবে পাত্তা দেওয়া হয় না। ছোটবেলা থেকে আমাদের কেরানি হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। আমি বাজারের সব প্রচলিত ও জনপ্রিয় বাংলা রচনা বই-এর একটাও পেলাম না যেখানে “আমার জীবনের লক্ষ্য” শীর্ষক রচনায় উদ্যোক্তা হওয়াকে বিষয় নির্বাচিত করেছে। আমি ছোটবেলায় আমাদের পরিবারের বিয়ের পাত্র বাছাইয়ে চাকুরীজিবীদের কাছে ব্যবসায়ীদের পরাজয় দেখেছি। তারমানে উদ্যোগ, উদ্যোক্তার ব্যাপারটা সমাজে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়”।
অন্যদিকে এটিও দেখা গেছে যে, কেউ কেউ নিজের একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য মাত্র ৫০ হাজার টাকা যোগাড় করতে পারে না, কিন্তু সেই একই লোক বিদেশে শ্রমিকের চাকরি নিয়ে যাওয়ার জন্য ৩ লাখ টাকা সহজে যোগাড় করতে পারে।
এই সব নানামুখী তথ্য, উপাত্ত এবং সম্ভাবনা দেখে মুনির হাসানের মনে হয়েছে, আমরা একটা উদ্যোগ নিতে পারি যা কিনা তরুনদের উদ্যোক্তা হ’তে উৎসাহ যোগাবে।
তিনি টেক শহরকে আরও বলেন, “কাজটা শুরু করি ২০১০ সালের শেষদিকে। প্রতিবছর আমাদের গনিত উৎসবের একটা বাৎসরিক থিম থাকে। সেবার আমরা গনিত উৎসবের জন্য বেছে নিলাম উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়টি। জাফর ইকবাল স্যারের দেওয়া শ্লোগানকে একটু এদিক, ওদিক করে আমাদের সোহাগ সেটিকে বানাল – চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব। সব বিভাগীয় উৎসবে আমরা ১জন করে উদ্যোক্তাকে হাজির করলাম। তারা তাদের জীবনের গল্প শোনালো আমাদের ছেলে-মেয়েদের। গণিত উৎসব শেষে এটিকে একট প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমরা ভাবলাম। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারপর ফেইসবুকে খুললাম একটি গ্রুপ, ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল”।
এভাবেই শুরু হলো ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের পথচলা।
যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রুপটি
গ্রুপের মূল কাজ হলো ভার্চুয়াল মেন্টরশীপ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। এই প্ল্যাটফর্মে এখন ১৯ হাজার+ সদস্য। তারা তাদের নিজ নিজ জানা তথ্য, অভিজ্ঞতা এবং সোসিং ও সের্সের বিষয় বিনিময় করেন। নানান সহায়তা দেওয়া হয়। সেখানে আপনি পেয়ে যাবেন এমন সব খবর যা আপনাকে উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী করে তুলতে পারে৷ কেননা পেজের পোস্টগুলো যেমন পরামর্শমূলক, তেমনি অনুপ্রেরণাদায়কও৷ একজন হয়ত একটা উদ্যোগ নিয়ে কিছু করতে চাইছেন, তার আগে এই পেজে পোস্ট দিয়ে সে ব্যাপারে সবার পরামর্শ চান৷ সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা হাজির হন বুদ্ধি নিয়ে৷ অনেকে আবার নিজ উদ্যোগের সফলতার গল্প শুনিয়ে অন্যদের উৎসাহ যোগান৷
মুনির হাসান বলেন, “১ বছর ফেইসবুকে কাজ করার পর আমরা ২০১২ সালের এপ্রিল মাস থেকে সরাসরি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেটে এখন আমাদের আয়োজনে কর্মশালা, উদ্যোক্তা আড্ডা, সেমিনার ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামে মে মাসের ১-৩ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে উদ্যোক্তা উৎসব, ঢাকায় করেছি উদ্যোক্তা হাট”।
যারা এই গ্রুপের সদস্য
গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যই বয়সে তরুন। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ এর কর্মী, সফল উদ্যোক্তা প্রমূখও এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
তৈরি হচ্ছে উদ্যোক্তা
গ্রুপটি থেকে পরামর্শ, অনুপ্রেরণার মাধ্যমে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয় বছরে এসব তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে সফল ৩১ জনকে গ্রুপের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই বছরে সংখ্যাটি এর ১০গুন ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্ঠরা। তবে, সরাসরি কেবল উদ্যোক্তা তৈরি করাটাই গ্রুপের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সমাজে উদ্যোক্তা বান্ধব একটা পরিবেশ সৃষ্টির জন্য লড়ছে গ্রুপটি। লড়াইটা দীর্ধমেয়াদী এবং এর সুফল পেতেও অনেক সময় লাগবে। কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হওয়ায় গ্রুপটি প্রেরণা পাচ্ছে। যেমন ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের ২০০০ উদ্যোক্তা তৈরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চেম্বারের সভাপতি আহবান করেছেন দেশের তরুনদের জীবনের লক্ষ্য যেন হয় – ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’।
বর্তমানে যে ধরণের কার্যক্রম রয়েছে
শুরুরদিকে কেবল ফেসবুক গ্রুপে এর কার্যক্রম সীমাবদ্দ ছিল এবং এর আওতা ছিল তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। বর্তমানে অনলাইন শেয়ারিং ও মেন্টরিং এর পাশাপাশি গ্রুপ থেকে সেমিনার, প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের বর্তমানে তিন ধরণের কার্যক্রম চালু রয়েছে। ফেসবুক গ্রুপে তথ্য, ভরসা এবং মেন্টরিং সার্ভিস; উদ্যোগ সংক্রান্ত নানান বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কর্মশালার আয়োজন এবং উদ্যোক্তাদের পণ্য ও সেবা তুলে ধরার জন্য উদ্যোক্তা উৎসব ও উদ্যোক্তা হাটের আয়োজন।
উদ্যোক্তা হাটের সফলতা
সম্প্রতি গ্রুপের উদ্যোগে আয়োজি ‘উদ্যোক্তা হাট’ খুবই সফল হয়েছে বলে মনে করেন মুনির হাসান। তিনি বলেন, “বিশেষ করে আমাদের তরুন উদ্যোক্তাদের আমরা সুযোগ করে দিতে পেরেছি যেন তারা কম খরচে নিজেদের পণ্য বা সেবা তুলে ধরতে পারে। তাদের জন্য নেটওয়ার্কিং-এরও ব্যবস্থা ছিল। তাছাড়া মিডিয়াগুলো আমাদেরকে অনেক সহায়তা করেছে”। এই হাটের মাধ্যমে আরও অনেক তরুণ উদ্যোক্তারা আগ্রহী বলে টেক শহরকে জানান তিনি।
আগামীর পরিকল্পনা
আগামীতে ‘উদ্যোক্তা ক্লিনিক’ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে এই গ্রুপটির। উদ্যোক্তা ক্লিনিকের উদ্যোক্তারা তাদের সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরাসরি একজন পরামর্শকের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এই নভেম্বরেই এটি চালু হবে। এছাড়া আগামী ১৪-১৬ তারিখ হবে উদ্যোক্তা বুট ক্যাম্প। এখানে সফলদের ও তরুণ উদ্যোক্তাদের মিলন মেলা হবে বলে প্রত্যাশা করছেন মুনির হাসান।
তৈরি হয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট
এই ফেসুবক গ্রুপের উদ্যোগে একটি ওয়েবসাইটও (uddokta.com.bd) চালু করা হয়েছে৷ এটি বর্তমানে পরীক্ষামূলক সংস্করণে রয়েছে বলে জানান মুনির হাসান।