প্রোটিনে অভাবনীয় সম্ভাবনা: ক্যান্সার শনাক্ত ও বুলেট তৈরিতে ব্যবহৃত হবে

টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর: জীবদেহে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে থাকে প্রোটিন বা আমিষ। এই পুষ্টি উপাদানটির সাহায্যে মানুষের শরীর গঠনের ভিত্তি, ত্বক, চুল এবং এনজাইম, সাইকোটাইন ও অ্যান্টিবডি গঠিত হয়। প্রোটিন বৃহৎ জৈব অনু এবং অ্যামিনো এসিডের এক বা একাধিক দীর্ঘ চেইন নিয়ে গঠিত। প্রোটিন সম্পর্কে আমাদের এতোদিন এই স্বাভাবিক, গড়পড়তা ধারনাই ছিলো। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট প্রোটিনের এক বিস্ময়কর ব্যবহার করেছে। অন্য অনেক বিজ্ঞানীরাও ক্যান্সার শনাক্তসহ প্রোটিনের ভেতর দারুন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পদার্থবিদ্যা পরীক্ষার জন্য রাখা লাইট গ্যাস গানটিতে সম্প্রতি বিশেষ এক ধরনের বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে। লেদ মেশিনের মতো বিশালাকার দেখতে লাইট গ্যাস গানটি সাধারনত প্রতি সেকেন্ডে ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার বেগে অথবা ঘন্টায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ মাইল বেগে প্রজেক্টাইল গুলি করতে পারে; যা একটি বুলেটের গতির প্রায় দ্বিগুন।

এই বন্দুকটিতেই ছোট একটি মটরের চেয়েও ছোট বেসাল্ট পাথরের টুকরো লোড করা হয়েছে; যা একটি বিশেষ জেলে বিস্ফোরিত হয়। জেলটি তৈরি হয়েছে প্রোটিন ট্যালিন দিয়ে। প্রোটিন ট্যালিন মূলত পরিশোধন করা প্রোটিনের একটি সংস্করন এবং এটিকে প্রভাব শোষণ করার অভাবনীয় ক্ষমতা দিতে টুইক করা হয়েছে।

Techshohor Youtube

বন্দুকের ব্যারেল থেকে টার্গেটটি সরানোর সাথে সাথে ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। জেলটি কিছুটা ঠেলে ভেতরে দেয়া হলেও তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জেলের পেছনে থাকা ধাতব প্লেটটির কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। এই জেলটি না থাকলে ব্যাসাল্টের কারণে প্লেটটির এক খন্ড ছিঁড়ে পড়তো। অন্যবদ্য যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ট্যালিন শক্তি শোষণ করতে পারে। ট্যালিনের কাঠামো অ্যামিনো এসিডের তৈরি প্রোটিনের ব্লকের মাধ্যমে গঠন করা হয়।

বান্ডিলগুলো টানা হলে ১০ নম্বর ফ্যাক্টরের মাধ্যমে প্রোটিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। চাপ ছেড়ে দেয়া হলে এটি আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। অধ্যাপক বেন গল্ট তার সহকর্মী অধ্যাপক জেনিফার হিসটককে সাথে নিয়ে তালিনের ট্যালিনের গঠন এবং এটি কিভাবে শক্তির বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের কর্মপ্রয়াসের ফলে তালিক একটি শক শোষণকারী উপাদান তা বের করা সম্ভব হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জেনিফার হিসটক বলেছেন, ‘আমি মূলত বেনের অফিসে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি আমার সাথে বিস্ময়কর প্রোটিনটি নিয়ে আলোচনা করেন। আমি তাকে বলেছিলাম আমাদের একটি বুলেট প্রুফ ভেস্ট তৈরি করতে হবে। আর এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে আমরা কাজ শুরু করি।’ ২০১৬ সালের শুরু থেকে তাদের দল ট্যালিন প্রোটিনগুলোকে একটি জালে যুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। এটি প্রায় কার্টুনের মতো স্ট্রেস এবং রিবাউন্ড করার মতো।

অধ্যাপক গল্ট ২০০৫ সাল থেকেই প্রোটিনের যান্ত্রিক বৈশিষ্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন গল্ট। সে হিসেবে তিনি এই কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। গল্ট বলেন, ‘ব্যাপারটি খুব সহজ ছিলো না। আমাদের ছয়জনের একটি দল চার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রোটিনের যান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে কাজ করেছে। এর পরের চারবছর আমরা শক্তির বিপরীতে তালিন কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা নিয়ে কাজ করেছি।’ প্রোটিনগুলো একটি জটিল অনু। এগুলো অ্যামিনো এসিডের স্ট্রিং দিয়ে তৈরি; কিছুটা স্ট্রিংয়ের পুতির মতো। এখানে ২০টি প্রকৃতিকভাবে ঘটতে থাকা অ্যামিনো এসিড রয়েছে। সাধারনত এই কাঠামোগুলো ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কপি এবং এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে কাজ করা হয়েছিল।

এই প্রক্রিয়ায় কাজ করতে সাধারনত কয়েক বছর সময় লাগে। তবে সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি এই প্রক্রিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখানে লক্ষ্য লক্ষ্য প্রোটিনের গঠনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে সিএএসপি ১৪ এ সবচেয়ে ভালো পারফর্মেন্স দেখায় আলফাফোল্ড। এই ভিন্ন ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রামটি প্রোটিনের গঠন নিয়ে দেয়। অন্য প্রতিদ্ব›দ্বীদের চেয়ে আলফাফোল্ড প্রোটিনের কাঠামো সম্পর্কে সবচেয়ে সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছিল। গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি আলফাবেটের এআই বিভাগ ডিপমাইন্ড এই আলফাফোল্ড তৈরির সাথে ছিলো। এ কাজে আরো সহায়তা করেছেন ক্যাথরিন টুনিয়াভুসনাকুল। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা জানতাম যে সেই সিএসপিতে যাওয়া অভ্যন্তরীণভাবে আমাদের ভালো ফলাফল এনে দিয়েছিল।’ আলফাফোল্ডের আরেক সংস্করন আলফাফোল্ড ২ বেশ ভালো।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রোটিন কাঠামোগুলো ক্যান্সার শনাক্তকরনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে এই প্রোটিন কাঠামো। ক্যান্সার কোষের সাথে আবদ্ধ হওয়ার কারণে আগের তুলনায় খুব দ্রুত ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে। প্রোটিনের এই কাঠামো গবেষণার গতিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। আলফাফোল্ডের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রোটিনগুলো প্রায়ই অন্যান্য অণুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে আলফাফোল্ড শুধুমাত্র প্রোটিন অংশের পূর্বাভাস দিতে পারে। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা প্রোটিনকে স্কার্চ থেকে নির্দিষ্ট কাজের জন্য ডিজাইন করতে চাইছেন। উইনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর প্রোটিন ডিজাইনের প্রধান অধ্যাপক ডেভিড বাকের তার গবেষণায় এ বিষয়টির ওপরেই জোর দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, প্রোটিন গবেষণা ‘খুবই চমকপ্রদ একটি বিষয়।’

ডেভিডের গবেষণা দলটি ডিএএলএল-ই’র ওপর ভিত্তি এআই তৈরি করেছে। এই এআই প্রকৃত ইমেজ তৈরি করে। আরএফ ডিফিউসন নামে পরিচিত এআইটি পরিচিত প্রোটিন ভেঙ্গে তা ধাপে ধাপে একত্রিত করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একটি নতুন প্রোটিনের বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিজ্ঞানীরা এই আরএফ ডিফিউসন ব্যবহার করে। অধ্যাপক বাকের বলেছেন, ‘আমি মনে করি আরএফ ডিফিউশন হচ্ছে আমাদের আগে যা ছিলো তার ধাপ পরিবর্তন। প্রোটিন ডিজাইন করার সম্ভবনা অনেক ভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান করবে; যা সত্যিকার অর্থেই চমৎকার।’

বিবিসি/আরএপি

*

*

আরও পড়ুন