ঘোর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে বিশ্ব অর্থনীতিতে


টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : ৭৫ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। সে যুদ্ধে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ও জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ দেশের শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেঙ্গে পড়ে, পুনরায় ঘুরে দাড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রসারন ও পুনরুদ্ধারের মতো সুবিশাল কার্যক্রম গ্রহন করতে হয়। বর্তমানে এ পৃথিবী নতুন আরেক যুদ্ধের সম্মুখিন। এবারের শত্রু অদৃশ্য ভাইরাস কোভিড-১৯।

দেখতে না পাওয়া এ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আরো একবার নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সাধারন মানুষের আয় কমছে, লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। এই মহামারীর প্রভাব অর্থনীতিতে কতোটা প্রকট হয়ে উঠতে পারে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমরা যে বড় ধরনের ধাক্কার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি সে বিষয়ে সবাই নিশ্চিত। বিশ্বব্যাংকের দেয়া সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনীতি সবচেয়ে বড় সংকোচনের মুখে পড়তে যাচ্ছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন গভীরতর মন্দা ধেয়ে আসছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের ‘২০২০ গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময় পরবর্তী সবচেয়ে বাজে মন্দার সম্মুখিন হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ি চলতি বছর সামগ্রিকভাবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি অর্থনীতি ৫ দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হবে। অথচ জানুয়ারিতে দেয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছিলো বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রাক্কলন অনুযায়ি অর্থনীতি সংকোচিত হলে এটি হবে ১৫০ বছরের মধ্যে চতুর্থ গভীরতর মন্দা। এর আগে ১৯১৪, ১৯৩০-৩২ এবং ১৯৪৫-৪৬ সালে মন্দায় নিমজ্জিত হয়েছিলো বিশ্ব অর্থনীতি।

Techshohor Youtube

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয় ,‘ করোনা ভাইরাস মহামারী এবং শাটডাউন কর্মসূচির প্রভাব সবাই খুব দ্রুত ও ব্যাপকভাবে অনুভব করবে।’ এরমধ্যে কারো ভোগান্তির মাত্রা বেশি হবে আবার কারো একটু কম। উদাহারন হিসেবে বলা যায়, বিশ্বের উন্নত অর্থনীতিগুলো সাত শতাংশ সংকোচিত হবে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও সংকোচিত হবে, কিন্তু এই হার মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

অঞ্চলভিত্তিকভাবে এই পার্থক্য হবে আরো ব্যাপক। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরমধ্যে ইউরোঅঞ্চলে সংকোচন হবে বেশি, ৯ দশমিক ১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ি পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে; যা ১৯৬৭ সালের পর সবচেয়ে শ্লথ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার অর্থনীতি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ সংকোচিত হবে।

সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় অর্থনীতি চলতি বছর সাত শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও সরবরাহ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়াই এর মূল কারণ। অন্যদিকে উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো (ইএমডিইএস) চলতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ সংকুচিত হবে। ৬০ বছরের মধ্যে এই প্রথম এসব দেশ সংকোচনের সম্মুখিন হতে যাচ্ছে।’

কোভিড-১৯ এর প্রকোপ ঠেকাতে লকডাউন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে সাধারন মানুষের উপার্জন কমে গিয়েছে। এ অবস্থায় মাথাপিছু আয় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ কমে যাবে বলেও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে প্রাক্কলন করা হয়েছে। মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার কারণে এ বছর লাখ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র বরন করতে হবে।’

বিশ্বব্যাংক বলছে ৯০ শতাংশ দেশেই মাথাপিছু উৎপাদন কমবে। এই হার ১৮৭০ সালের পর সর্বোচ্চ। এছাড়া মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার ফলে সাত থেকে ১০ কোটি মানুষ অতি-দারিদ্রতার মুখে পতিত হবে।

গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, যেসব দেশে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি এবং যেসব দেশ বৈশ্বিক বাণিজ্য, পর্যটন, কমোডিটি পণ্য রফতানি এবং বর্হিবিশ্বের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বিশ্বব্যাংকের সরবরাহ করা অনলাইন টুল পোভক্যালনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের দারিদ্রতার অবস্থা পরিমাপ করা হয়। সংস্থাটির ডাটা ও রিসার্চ গ্রুপ যৌথভাবে এ টুলটি পরিচালনা করে থাকে। পোভক্যালনেটের সাহায্যে সম্পাদিত হিসাবে দেখা গিয়েছে ১৯৯৮ সালের পর কোভিড-১৯ এর কারণে প্রথমবারের মতো বিশ্বে দারিদ্রের হার বাড়তে যাচ্ছে। তখন এশিয়ার আর্থিক সংকটের কারণে দারিদ্রতার হার বেড়ে গিয়েছিলো। নতুন পূর্বাভাস অনুযায়ি বৈশ্বিক দারিদ্রতার হার (দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম অর্থে জীবনব্যয় নির্বাহ করা) ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি বছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। অর্থাৎ গত বছর বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিলো ৬৩ কোটি ২০ লাখ, যা এ বছর বেড়ে হবে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ জন। অথচ গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন প্রতিবেদনে দারিদ্রতার হার হ্রাসের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিলো।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ইকুইটেবল গ্রোথ,ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেইলা পাজারনাসোইগলো বলেন,‘ আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জরুরী দিকগুলো চিহ্নিত করা। এরপর আরো বেশি মানুষ যাতে দরিদ্র ও বেকার না হয়ে পড়ে সে জন্য দ্রত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে।’

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রসপেকটস গ্রুপের পরিচালক আহিয়ান কোজ বলেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে হিসাব করে বলা হচ্ছে কোভিড-১৯ মন্দার সৃষ্টি করবে এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর তা বেশি অনুভূত হবে। এছাড়া ছয় দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো উৎপাদনে সংকোচনের সম্মুখিন হবে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।’

মূলত স্বাভাবিক সময়ে একটি দেশের অর্থনীতি তার নিজস্ব গতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে। সে দেশের পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসাধারনেরও আয় বাড়ে এবং সামগ্রিকভাবে জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কিছু কিছু সময় আসে যখন পণ্য ও সেবার মূল্য কমতে থাকে। যখন দুই থেকে তিন মাস অথবা গোটা এক প্রান্তিক ধরে এমনটা ঘটতে থাকে তখনই অর্থনীতি মন্দাগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। গত বছরের শেষের দিকে চীন থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপ চলছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। দীর্ঘ এ সময় ধরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমও শ্লথ হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন চলছে। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় লোকসান গুনতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা , মেক্সিকোর মতো উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মন্দায় পড়বে বলে সতর্ক করা হচ্ছে। এরইমধ্যে মন্দায় নিমজ্জিত হয়েছে জাপান ও জার্মানি। করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা হলেও হ্রাস করতে সুদের হার প্রায় শূণ্যে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রিয় ব্যাংকগুলো।

অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এক জরিপে বলা হয়েছে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের মন্দায় নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ। জানুয়ারিতে একই জরিপে এই হার ছিলো ২৫ শতাংশ। প্যাসিফিক ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (পিমকো) সম্প্রতি তাদের গ্রাহকদের জানায় করোনা ভাইরাস মহামারী প্রচ্ছন্ন মন্দার সৃষ্টি করবে। অথবা যুক্তরাষ্ট্রে টানা দুই প্রান্তিক এবং ইউরোঅঞ্চলে প্রথমার্ধ পর্যন্ত ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি থাকবে।

এছাড়া আকস্মিকভাবে এই মন্দা সৃষ্টি হওয়ার কারণে ভোগান্তির মাত্রাও বেশি হবে বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিওএফএ সিকিউরিটিজের মার্কিন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান মিশেল মেয়ার বলেন, বিষয়টি খুব দ্রত ঘটছে তাই এর ধাক্কার ওজনটাও অনেক বেশি হবে।

সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দুই ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভূত হতে পারে বলে অনুমান করছে বিশ্বব্যাংক। এক- ধারণার চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে কোভিড-১৯ বিরাজ করবে এবং বর্তমানে চলমান বিধিনিষেধও অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় ৮ শতাংশ সংকোচিত হবে। আর যদি খুব শিগগিরই যদি নিয়ন্ত্রনমূলক কর্মসূচিগুলো তুলে নেয়া হয় তাহলে এই সংকোচনের মাত্রা হবে ৪ শতাংশ। তা সত্ত্বেও ২০০৯ সালের আর্থিক সংকটের পর এটি হবে দ্বিগুন মাত্রার সংকোচন।

*

*

আরও পড়ুন