ইন্টারনেটে বাংলায় নানা নকশার ফন্ট

নুরুন্নবী চৌধুরী, স্পেশাল করসপনডেন্ট: প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখা বা পড়ার সুযোগ এখন বেশ উন্নত। শুধু কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপেই নয়, বরং এখন হাতের মুঠোফোনেও রয়েছে বাংলা কীবোর্ড, রয়েছে একাধিকে বাংলা লেখার লেআউট যার সাহায্যে যেকোন সময়েই পড়া যাচ্ছে বাংলা আবার লেখা যাচ্ছে বাংলায়। বাংলায় লেখার এমন আনন্দ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে নানা ভাবে। এখন বাংলায় এসএমএস থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা লেখা, চ্যাট করাসহ অনেককিছুই হচ্ছে। এদিক দিয়ে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু ইউনিকোড ফন্ট ব্যবহার করে অনেকেই কাজ করছেন। তবে ফন্ট নিয়ে কাজ এখানেই থেমে নেই। নানা ধরনের নকশার ফন্ট নিয়মিত ভাবেই তৈরি হচ্ছে এবং সেগুলো অনলাইন দুনিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে। ডিজিটাল দুনিয়ার বাইরে আমাদের প্রতিদিনের পথে চোখ দিলেই বোঝা যায়। এখন আর পোস্টার, ব্যানার বা ডিজিটাল দুনিয়ার কোন প্রচারণা নির্দিষ্ট কোন ফন্টে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের অনেক তরুণ দারুণ সব ফন্ট তৈরি করছেন যা আসকি সংস্করণের পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে ইউনিকোড ফরম্যাটেও।

নানা নকশার বাংলা ফন্ট

বাংলা ভাষায় নানা ধরনের ফন্ট বর্তমানে পাওয়া যায়। যেসব ফন্টে বই থেকে পত্রিকা বা ম্যাগাজিন ছাপা হতো সেখান থেকে বর্তমানে ইন্টারনেট দুনিয়ায় বাংলা লেখা বা পড়ার জায়গায় এসেছে পরিবর্তন। বাংলা ভাষার সফটওয়্যার হিসেবে বহুল পরিচিত ‘বিজয়’। ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু হওয়া এ সফটওয়্যারে সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হয় এক ঝাঁক বাংলা ফন্ট। সেসব ফন্ট অফলাইন প্রিন্ট জগতে বহুল ব্যবহৃত। ২০১১ সালে এ সফটওয়্যারে থাকা ফন্টগুলোর ইউনিকোড সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বিজয়ের উদ্ভাবক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহরকে বলেন, ‘বাংলা ফন্টের মূলত দুইটি ব্যবহার আছে। একটা আসকি, অন্যটি ইউনিকোড। এর মধ্যে প্রিন্ট দুনিয়ায় জন্য ‘আসকি’ এবং অনলাইনের জন্য ‘ইউনিকোড’। আমি ১৯৮৮ সালের আগে তৈরি করি ‘আনন্দ’ নামের ফন্ট যা পরবর্তীতে ‘সুনন্দা’ নামকরণ হয়। এ দুটি ছিল শুধু ফন্ট। পরবর্তীতে যখন ১৯৮৮ সালে বিজয় সফটওয়্যার প্রকাশ করি সেখানে ‘সুতন্বী’ নামের ফন্ট যুক্ত হয়। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের তৈরি ১০৮টি ফন্টই প্রকাশনায় সর্বাধিক ব্যবহৃত ফন্ট। প্রকাশনা ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমেই এ ফন্টগুলোই ব্যবহৃত হয়ে আসছে নানা ভাবে। বৈচিত্রতার বিষয়টি আমরা আনতে পেরেছি যা সত্যিই বাংলা লেখায় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।’ নতুন প্রজন্মের অনেকের তৈরি বিভিন্ন ধরনের বাংলা ফন্ট তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন,  ‘বাঙালি জাতির হরফ যে কেউ কাজ করতে পারে এবং ফন্ট তৈরি করতে পারে। বিষয়টিকে অবশ্যই স্বাগত জানাই।’

Techshohor Youtube

ইউনিকোড ফন্ট হিসেবে বেশ কিছু বাংলা ফন্ট বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সোলায়মান করিমের তৈরি ‘সোলায়মান লিপি’, তানবীন ইসলাম সিয়ামের তৈরি ‘সিয়াম রূপালী’, ‘কালপুরুষ’ নামের ইউনিকোড ফন্টগুলো ব্যবহারকারী বা পাঠকদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পায়। বাংলা কম্পিউটিং এবং লোকালাইজেশন ভিত্তিক প্রকল্প ‘একুশে’র জন্য এসব ফন্ট তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে রূপালী ফন্টকে নতুন ভাবে ইউনিকোড সংস্করণে তৈরি করে ‘সিয়াম রূপালী’ ফন্ট নামে প্রকাশ করেন তানবীন ইসলাম সিয়াম। তিনি ২০১০ সালে তৈরি করেন ‘কালপুরুষ’ নামের আরেকটি ফন্ট। তানবীন ইসলাম সিয়াম টেকশহরকে বলেন, ‘আসলে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোলাগা থেকেই ফন্টগুলো তৈরি করেছিলাম যা এখন সকলের জন্য উন্মুক্ত।’ তিনি উল্লেখ করেন, জনপ্রিয় কীবোর্ড ‘অভ্র’র সঙ্গে বর্তমানে নিজের তৈরি ফন্টগুলো যুক্ত থাকায় ‘অভ্র’ ব্যবহারকারী সকলেই ফন্টগুলো ব্যবহার করতে পারেন সহজেই।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০২০ সালে ‘ইউএন বাংলা’ নামের একটি ফন্ট তৈরি করে। সে ফন্টটির ইউনিকোড সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে আজ আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবসে। ফন্টটির বিষয়ে ইউএনডিপি বাংলাদেশের হেড অফ কমিউনিকেশনস মো. আব্দুল কাইয়ূম টেকশহরকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে, ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করি যার নাম দেয়া হয় ‘ইউএন বাংলা’। এটির ইউনিকোড সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে যে সংস্করণটি ইউএনডিপি বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।’

ফন্টের যত ওয়েবসাইট

এক সময়ে নানা নকশার বিভিন্ন ফন্ট পাওয়া যেত ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার জন্য। তবে এখন বাংলা ভাষায়ও নানা ধরনের ফন্টের ওয়েবসাইট রয়েছে যেখানে নানা নকশটার ফন্ট পাওয়া যায়। ১৯৯৮ সালে বাংলা ফন্ট নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী এমন একদল মানুষদের উদ্যোগে শুরু হয় ‘একুশে’ (https://ekushey.org) ওয়েবসাইট যেখানে সোলায়মান লিপি, রূপালী, একুশে আমার বাংলা, একুশে আলো, একুশে লাল সবুজ, একুশে লোহিতসহ নানা ধরনের ইউনিকোড ফন্ট রয়েছে। একুশে ডট অর্গের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা অমি আজাদ জানান, ‘আমরা আসলে সে সময়ে বাংলা ফন্ট নিয়ে কাজ করে কয়েকজন মিলেই একুশে শুরু করি।

এছাড়াও ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ২০০টির বেশি ফন্টের জনপ্রিয়একটি ওয়েবসাইট ‘লিপিঘর’ (https://lipighor.com)। এ সাইটে রয়েছে আলিনুর বৈশাখ, আলিনুর দেয়ালিকা, স্বর্ণালী অক্ষর, পাতাবাহার, সিরাজী শেখ, সিরাজী সিলেটী, হাসান আঁকিবুঁকি, মাহফুজ একে, শহীদ জব্বার, শহীদ শফিউর, শহীদ বরকতসহ নানা ফন্ট। লিপিঘরের প্রতিষ্ঠাতা নিলাদ্রী শেখর বালা টেকশহরকে বলেন, ‘বর্ণমালার সৌন্দর্যায়নের লক্ষ্যে আমরা ২০০টি নতুন বাংলা ফন্টের মাইলফলক অতিক্রম করেছি। আমরা কয়েক হাজারেরও অধিক ফন্ট তৈরি করার মাধ্যমে মাতৃভাষা বাংলাকে সমৃদ্ধ করে আপামর বাঙালির কাছে বাংলা লিপির ব্যবহারকে আরও নন্দিত করতে পারি।’ লিপিঘরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ফন্ট নির্মাতা মো. আলিনুর রহমান। এ সাইটে তার প্রকাশিত ফন্টের সংখ্যা ৬৬টি। ফন্ট তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন ভাষা নিয়ে রক্ত দিয়েছে বাঙালিরা তখন হয়তো অংশ নিতে পারিনি তবে এখন বাংলাকে ভালোবেসে ফন্ট তৈরির মাধ্যমে সেই ভালোলাগার কাজটি করে যাচ্ছি’। নতুন কেউ ফন্ট নির্মানে আগ্রহী হলে তাদের দিকনির্দেশনা দেয়ার ইচ্ছে আছে উল্লেখ করে স্নাতক শিক্ষার্থী আলিনুর জানালেন, ‘আগ্রহীদের যে কোন ধরনের সহযোগিতা দিতে চাই, যতটুকু সম্ভব। যাতে করে বাংলা ফন্টের ব্যাপ্তি আরো বাড়ে।’

লিপিঘরে বর্তমানে রয়েছে ২০১টি ফন্ট যা এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত এক কোটি ২২ হাজারের বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে।

নানা নকশার দারুণ সব ফন্ট নিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফন্টবিডি (https://fontbd.com)। এ সাইটের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা তরুণ শরীফ উদ্দিন শিশিরের তৈরি করা বাংলা ফন্টের সংখ্যা ৩৬টি। গ্রাফিক্স আর্টিস্ট শিশির ফন্ট তৈরির পাশাপাশি বাংলা ক্যালিওগ্রাফিও করে থাকেন। এ সাইটে ফন্টের মধ্যে রয়েছে শরীফ তিস্তা, শরীফ জনতা, শরীফ সুবর্ণ, শরীফ মিতালী, শরীফ স্বন্দীপ, শরীফ বঙ্গবন্ধু, শরীফ আদর, শরীফ শিশির, শরীফ শাহজাহান, শরীফ হাবিবা, শরীফ জোসনা, নূর আলম একাত্তর, কিংবদন্তী, মোমেনশাহী বাংলা, হেলাল ফারজানা, মাহফুজ কিশোরগঞ্জ ইত্যাদি। সাইটটিতে যেমন রয়েছে বিনামূল্যের ফন্ট তেমনি রয়েছে প্রিমিয়াম ফন্ট। বর্তমানে এ সাইটে রয়েছে ১৫২টি ফন্ট যা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডাউনলোড হয়েছে ২২ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি। ফন্ট এবং এ সাইট সম্পর্কে শরীফ উদ্দিন শিশির টেকশহরকে বলেন, ‘২০২১ সালে যাত্রা শুরু হয় হয় ফন্টবিডি ওয়েবসাইটের। বাংলাকে ভালোবেসে সুন্দর নকশায় নিজস্ব স্বকীয়তা ও নিজস্বতার কথা চিন্তা করে বাংলা ফন্ট নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যেই এ সাইটের যাত্রা শুরু।’ ভবিষ্যৎতে আরো নানান ফন্ট তৈরির ব্যাপারে কাজ করার ইচ্ছের কথাও জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ সরকারের বাংলা ফন্ট ও উদ্যোগ

বাংলাদেশ নির্বাচন সচিবালয় কর্তৃক তৈরি কৃত ফন্ট ‘নিকস’ বর্তমানে সরকারি ভাবে সকল কাজে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত। এ ফন্টটি সরকারের সকল ধরনের প্রজ্ঞাপন বা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ফন্টটি পাওয়া যাবে নির্বাচন কমিশন ওয়েবসাইটে (http:// ecs.gov.bd/page/download)। এছাড়াও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি)-র তত্ত্বাবধানে ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (ইবিএলআইসিটি) প্রকল্পের আওতায়ও ফন্ট নিয়ে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। এ প্রকল্পের আইটি স্পেশালিস্ট মোহাম্মাদ আলী টেকশহরকে জানান, ‘প্রযুক্তি মাধ্যমে বাংলা ফন্টের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে নতুন একটি ফন্ট তৈরির কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে, ফন্টটি ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্টারনেট অথবা কম্পিউটারে প্রায়োগিক সকল সমস্যা সমাধান হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, এ প্রকল্পের আওতায় সত্যজিৎ রায়, কাইয়ুম চৌধুরীর, সংবিধানে ব্যবহৃত অক্ষর-শিল্পের মতো শিল্পীর টাইপোগ্রাফি বা বাংলা পুথির লেখাকে থেকে বাংলা ফন্টে রূপান্তর করার সুযোগ রয়েছে, এছাড়াও কমিকসের ফন্ট, ক্যারিকেচারের ফন্ট, ডিজিট-বান্ধব কিংবা অন্য বিশেষায়িত ফন্ট তৈরির সুযোগ রয়েছে। এজন্য বাংলা বর্ণের সৌন্দর্যমণ্ডিত অবয়বকে ডিজিটাইজড করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’ এ প্রকল্পের বিস্তারিত জানা যাবে https://bangla.gov.bd ঠিকানায়।

*

*

আরও পড়ুন