![]() |
আল-আমীন দেওয়ান : বকেয়া পরিশোধের আশ্বাস ও বিনিয়োগ এনে ফেরার ‘গল্প’ দিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না সিটিসেলের।
প্রথম এই মোবাইল ফোন অপারেটরটির লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। ইতোমধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পূর্বানুমোদন চেয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহর ডটকমকে জানিয়েছেন, ‘সিটিসেলের লাইসেন্স রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।’
এরআগে ‘নির্ধারিত সময়ে সরকারের বকেয়া পরিশোধ না করায়’ প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড বা সিটিসেলের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না-কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় বিটিআরসি। ২০২২ সালের অক্টোবরে ৩০ দিন সময় দিয়ে এই নোটিশ দেয়ার আগেও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পূর্বানুমোদন নিয়েছিলো নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।
সিটিসেলের টুজি সেলুলার মোবাইল অপারেটর লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্তের আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রেডিও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট লাইসেন্স ও তরঙ্গ বাতিল করে দেয়া হয়।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ যখনই কেউ লাইসেন্সের শর্ত মানবে না, তখন লাইসেন্স বাতিল হবে এটা স্বাভাবিক। আমি নীতিগতভাবে মনে করি, এই ধরনের প্রতিষ্ঠান এখন কী করবে । ইভেন প্রযুক্তিগতভাবে দেখতে গেলে খুব স্পষ্টভাবে এটা বলতে হবে যে, সিটিসেলের যে প্রযুক্তি, সে প্রযুক্তি এখন বিশ্বেই ব্যবহৃত হয় না। এই লাইসেন্স দিয়ে রাখার তো প্রশ্ন নেই।’
‘সরকারের পাওনা আদায় করার দায়িত্ব বিটিআরসির, এজন্য আইনানুগভাবে যা যা করা দরকার তার সবই করবে বিটিআরসি’ বলছিলেন মন্ত্রী।
কী বলছে সিটিসেল ?
কেন লাইসেন্স বাতিল করা হবে না, এই নোটিশের জবাবে সিটিসেল বিটিআরসিকে জানিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে তাদের অভিভাবক ও রক্ষাকারী বিটিআরসি। অনাকাংখিতভাবে এই পরিস্থিতিতে বিটিআরসি তাদের প্রত্যাশিত সুরক্ষা দিচ্ছে না।
ওই চিঠিতে সিটিসেল বলেছে, ‘ তারা নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য চেষ্ট করছে যেন নতুন করে কার্যক্রম চালু করা যায়। আর এই আলোচনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘ম্যাচিউরড’ হয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এটি আড়াই বছর পিছিয়ে গেছে। এরপর তারা যখন আবার উদ্যোগ নেয় তখন শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ইউক্রেন যুক্ত শুরু হয়।’
চিঠিতে তারা উল্লেখ করে, ‘শ্রীলংকান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। এসব কারণে বিনিয়োগকারী হয়তো এখনও চলে যায়নি কিন্তু আরও সময় নিচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে।’
তারা বলছে, ‘পাওনার বিষয়টি এখন আপিল বিভাগে রিভিউয়ে রয়েছে। এখন কোনো অংশীজন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা ‘কনটেম্পট অব কোর্ট’ হতে পারে।’
বিটিআরসির আইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লেক্স কাউন্সিলের অংশীদার ব্যারিস্টার খন্দকার রেজা-ই-রাকিব টেকশহর ডটমককে জানান, ‘আইন অনুযায়ী বিটিআরসি সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে।’
টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ফরেন চেম্বার্স অ্যান্ড কমার্সের নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নূরুল কবীর টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘ একটি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক নেই, কার্যক্রমও বন্ধ, তরঙ্গও নেই-সব বিবেচনায় এখানে কীভাবে বিনিয়োগ আছে ! সিটিসেলে বিনিয়োগ আসার বিষয়টি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না, এর যুক্তিযুক্ত ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। ‘
টেলিযোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের অনেকেই বলছেন, সিটিসেলের যা অবস্থা তাতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আশা ‘গল্পই’।
বিটিআরসি পাওনা কতো ?
বিটিআরসি বলছে, ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তাদের পাওনা ২১৮ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার ৬৫৯ টাকা। এই টাকার উপর বিলম্ব ফি বকেয়া পরিশোধের দিন পর্যন্ত যোগ হবে বা আদালতের রায় অনুযায়ী দিতে হবে।
আর ছয় বছর ধরে বন্ধ প্রতিষ্ঠানটির দেনা দিনদিন বেড়েই চলেছে । যেখানে যোগ হচ্ছে বার্ষিক লাইসেন্স ফি, ভ্যাট ও বিলম্ব ফি।
আগে যা ঘটেছে :
বিটিআরসি ২০২২ সালের ২৬ মে সিটিসেলকে চিঠি দিয়ে তখন ১২৮ কোটি ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৩ টাকাসহ যত পাওনা হয়েছে তা পরিশোধ করতে বলে। ওই চিঠিতে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়। সিটিসেল ওই বছরের ৯ জুন সেই চিঠির উত্তরে বিটিআরসিকে জানায়, বকেয়ার বিষয়টি উচ্চ-আদালতে বিচারাধীন থাকায় এ বিষয়ে তাদের কোনো মন্তব্য নেই।
এ অবস্থায় বিটিআরসি প্রথমে প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড বা সিটিসেলের রেডিও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট লাইসেন্স ও তরঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর তাদের টুজি সেলুলার মোবাইল অপারেটর লাইসেন্স বাতিলে কারণ দর্শানো নোটিশ দিতে সরকারের কাছে অনুমোদন চায়।
এরআগে ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের সকল আয়োজনই সম্পন্ন করে ফেলেছিলো নিয়ন্ত্রণ কমিশন। এমনকি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর টেবিলও ঘুরে এসেছিল লাইসেন্স বাতিলের ফাইল।
তখন সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে বিটিআরসি মূলত পুরোনো বকেয়া পরিশোধ না করা, আদালতের নির্দেশ অনুসারে চলতি দেনা যেমন স্পেকট্রাম এবং লাইসেন্স ফি পরিশোধ না করা এবং লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগ আনে।
এরপর সিটিসেল আদালতে গেলে বিটিআরসির বন্ধ করা স্পেকট্রাম ফেরত এবং লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেন আদালত।
এদিকে বকেয়া আদায়ে সিটিসেলের সঙ্গে বিটিআরসির মামলা এখনও চলছে। যেখানে আদালতের রায় অনুযায়ী সিটিসেল বিটিআরসির এই পাওনা পরিশোধ করলে বিটিআরসির দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি হবে বিবেচিত হবে।
২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আপীল বিভাগের রায়ে, সিটিসিলেকে বিটিআরসির দাবি করা রাজস্ব বা পাওনার দুই তৃতীয়াংশ ওই তারিখ হতে চার সপ্তাহের মধ্যে এবং অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী এক মাসের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।
একইসঙ্গে আদালত বিটিআরসির দাবি করা পাওনা পুন:বিবেচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি করে দেন । ওই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ীই অপারেটরটির কাছে এই ১২৮ কোটি ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৩ টাকা পাবে বিটিআরসি।
প্রতিবেদন অনুসারে, লাইসেন্স নবায়নের স্পেকট্রাম ফি’র দুই কিস্তির টাকা বাকি থাকাসহ ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সব মিলে অপারেটরটির বকেয়া হয় ৩৭২ কোটি ৭২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৬৭ টাকা। যার মধ্যে আদালতের রায় অনুযায়ী পরিশোধ করা হয় ২৪৪ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৪৪৪ টাকা।
আর ওই পাওনা টাকার সঙ্গে বার্ষিক লাইসেন্স ফি, বার্ষিক স্পেকট্রাম ফি এবং এরসঙ্গে ভ্যাট ও বিলম্ব ফি যোগ হয়ে সিটিসেলের দেনা দিনদিন বেড়েই চলেছে।
১৯৮৯ সালে দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্স পেয়ে সিটিসেল ১৯৯৩ সাল থেকে সেবা দিতে শুরু করে।
অপারেটরটির ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরের টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা কোম্পানি সিংটেল-এর হাতে।
আর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খানের প্যাসিফিক মোটর্সের রয়েছে ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ার। এছাড়া ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ফার ইস্ট টেলিকমের হাতে। সেটিও আসলে মোর্শেদ খানেরই আরেকটি কোম্পানি।
প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড বা সিটিসেলের টুজি সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর লাইসেন্স (নবায়নকৃত) ২০২৬ সালের ১০ নভেম্বর শেষ হবে।