![]() |
রাবেয়া আশরাফি পিংকি, টেক শহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : ডিজিটাল বিশ্বে কথোপকথনে সক্ষম এআই প্রযুক্তি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই প্রযুক্তি যোগাযোগকে আরও মসৃণ করে তোলে।
ইন্টারনেট দুনিয়ায় বর্তমানে চ্যাটজিপিটি নামে এমনই এক এআই প্রযুক্তি দারুণ আলোচিত নাম । বলা হচ্ছে, এটি হবে গুগলের মতো জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিনগুলোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রভাবশালী এই চ্যাটজিপিটি মূলত একটি ইন্টারনেট চ্যাটবট প্লাটফর্ম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যাবতকালের মধ্যে সেরা নিদর্শন হওয়ায় ইতোমধ্যেই চ্যাটবটটি দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মোচনের প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যেই ১০ লাখ ব্যবহারকারি এই চ্যাটবট প্লাটফর্মে নিবন্ধন করেছে। অথচ এই পরিমাণ ব্যবহারকারি পেতে গতানুগতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই এই চ্যাটজিপিটি চালু করেছে। চ্যাটজিপিটি নিয়ে যেমন অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এটি আশা অনুযায়ি সফল হতে পারবে কিনা তা নিয়েও কিন্তু সংশয় রয়েছে।
চ্যাট জিপিটি কি?
এ বিষয়টি জানার আগে ‘চ্যাটবট’ শব্দটির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। চ্যাটবট হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার; যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইন্টারনেটের বিভিন্ন কাজ করে। এটি ওয়েববট, ডব্লিউ ডব্লিউ বট বা সাধারণভাবে বট নামেও পরিচিত। এটি অগণিত ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত একটি বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। এরফলে ডিভাইসের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মানুষের মতো করে রিপ্লাই দিতে পারে।
এখন আসা যাক চ্যাটজিপিটি প্রসঙ্গে। এটি একটি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সফটওয়্যার। চ্যাট জিপিটির পূর্ণরূপ হচ্ছে জেনারেটিভ প্রি-ট্রেনড ট্রান্সফরমার। এটি একটি প্রশিক্ষিত ট্রান্সফরমার। চ্যাট জিপিটিতে ট্রান্সফরমার একটি মেশিন লার্নিং মডেল; যা কোন কিছুর বিষয়ে সহজে বোঝতে পারে। ডেইলি মেইল অনলাইনের এক প্রতিবেদনে ওপেন এআই এ পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক নামের একটি মেশিন লার্নিং কৌশল ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। নানারকম বিষয়বস্তু নিয়ে মানুষের মতো করে প্রশ্নের উত্তর দিতে চ্যাটজিটিপিতে নিজেদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে ওপেন এআই।
এই চ্যাটবটকে যেকোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগ সময়ে ঝটপট উত্তর দিয়ে দেয়। যেমন: চ্যাট জিপিটিকে কোনো কবিতা লিখতে বললে আপনার জন্য কবিতা লিখে দিবে। তবে এই চ্যাট জিপিটির সমাবদ্ধতা হলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা তথ্যগুলোই গুছিয়ে উপস্থাপন করে এটি। নতুন বা সদ্য কোনো তথ্য এটি জানে না। কিন্তু এরপরেও প্রযুক্তি বোদ্ধারা একে গুগলের চেয়ে উত্তম বলছেন। কারণ এরকাছে কোনো কিছু জানতে চাইলে গুগলের মতো হাজারো লিংক দেখায় না। সঠিক উত্তরটিই গুছিয়ে উপস্থাপন করে চ্যাটজিপিটি। এছাড়া রচনা লেখা থেকে শুরু করে গানের লিরিক্স লেখা, গল্প লেখা, কোন বিষয়ে প্রতিবেদন লেখা, স্ক্রিপ্ট এমনকি অভিযোগ পত্র লেখারও নির্দেশ দেয়া যাবে এই চ্যাটবটকে। শুধু তাই নয় অংক করা থেকে শুরু করে যেকোনো প্রশ্নের তড়িৎ উত্তর দিতে সক্ষম এই চ্যাটজিপিটি। সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের নানা সমস্যারও সমাধান দিতে পারে চ্যাটবটটি।
চ্যাট জিপিটির কর্ণধার ওপেনএআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক ওপেন এআইয়ের একজন প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৫ সালে স্যাম অল্টম্যান, গ্রেগ ব্রুকম্যান, রেইড হফম্যান, জেসিকা লিভিংস্টোন, পিটার থিয়েল, জেসিকা লিভিংস্টোন এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস, ইনফয়েস, ওয়াইসি রিসার্চ এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে ওপেন এআই প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিশ্রুত বিনিয়োগের পরিমান ছিলো ১০০ কোটি ডলারের বেশি। বর্তমানে কোম্পানিটির সিইও স্যাম অল্টম্যান। ইলন মাস্ক কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরে গেলেও এর একজন দাতা হিসেবে রয়ে গিয়েছেন।
চ্যাটজিপিটি কিভাবে কাজ করে?
চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন কতটুকু বুঝতে পারে ও কতোটা গভীরতরভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয় তা বোঝতেই গত বছরের ৩০ নভেম্বর প্লাটফর্মটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এটি ঠিক অনলাইনে মানুষের লেখা বার্তার মতো আলোচনা চালিয়ে যায়। ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন কনটেন্ট তরি, কাস্টমার সার্ভিস সংক্রান্তও নানা প্রশ্নের উত্তর মানুষের মতো করেই দিতে পারে এই চ্যাটজিপিটি। মানুষের কথাবলার ধরণ অনুসরন করে চ্যাটবটটি অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। গবেষণামূলক কাজে চ্যাটজিপিটি দারুন সহযোগির ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন- কেউ একজন কিছু তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনের জন্য সারণি বানিয়ে দিতে বলা হলে চ্যাটজিপিটি মুহুর্তের মধ্যে তা করে দিতে পারে। এছাড়া কোন বিষয়ে প্রতিবেদন লিখে দেয়ার নির্দেশ দিলেও সাথে সাথে হয়ে যায়।
চ্যাটজিপিটি গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের হুমকি হবে কিনা?
বিভিন্ন ডিভাইসে কথাবলার ধরণে চ্যাটজিপিটি আমূল পরিবর্তন আনবে বলে বলা হচ্ছে। এছাড়াও কোন বিষয়ে অনুসন্ধানে আরো সমৃদ্ধ উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে এটি গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হুমকি হবে কি? গুগলের সমালোচকরা বলছেন এই সার্চ ইঞ্জিণটি বর্তমানে মুনাফার দিকে বেশি ঝুঁকছে। কোন কিছু জানতে চেয়ে এখানে সার্চ করলে বিজ্ঞাপনের ভিড়ে সঠিক তথ্য খোঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে এ ধরনের সার্চ ইঞ্জিনের আধিপত্য দ্রুত শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এ ধরনের কোন সম্ভাবনা রয়েছে কি না সে বিষয়ে চ্যাটজিপিটিকে প্রশ্ন করা হলে এর বিপরিত উত্তর পাওয়া যায়। ডেইলি মেইলকে এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই চ্যাটবটটি নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য বানানো হয়েছে। অন্যদিকে গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলো হলো প্রচুর পরিমাণে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য।
অবশ্য গুগল বর্তমানে নিজস্ব এআই প্রতিষ্ঠা করেছে।
চ্যাটজিপিটির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ :
বলা হয় চ্যাটজিটিপি অনুসন্ধানের ধারণা আমূল বদলে দিবে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি গুগলের থেকেও ভালো কাজ করবে। ভবিষ্যতে চ্যাটজিটিপির বিশাল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ওপেনএআইয়ে সম্প্রতি বিনিয়োগের ঘোষণা মাইক্রোসফট। কোম্পানিটি মাইক্রোসফটের প্রাথমিক বিনিয়োগকারি। নিজেদের পণ্যের সাথে আরো বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যোগ করার বড় ধরনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এ বিনিয়োগ করছে বিল গেটসের কোম্পানিটি।
তবে চ্যাটজিটিপি নিয়ে উদ্বেগও কম নয়। বর্ণ, লিঙ্গ ও সংস্কৃতি নিয়ে সামাজিক পক্ষপাতিত্বের জন্য এআই প্রযুক্তি সমালোচিত। অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো চ্যাটজিটিপিও ত্রুটিমুক্ত নয়। স্বয়ং ইলন মাস্কই এই প্রযুক্তিটিকে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেক সময় এটি ভুল অথবা অর্থহিন উত্তর দেয়।
অবশ্য চ্যাটজিপিটিকে আরো নির্ভুল করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ওপেনএআই। নিয়ে আসছে এর নতুন সংস্করণ। যেখানে উত্তর দেয়া, ভুল স্বিকার করা, ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করা ও সঠিক নয় এমন অনুরোধ প্রত্যাখান করার মতো দক্ষ হয়ে উঠছে চ্যাটবটটি। এই বটের লেখা, জটিল কাজ করার দক্ষতা ও সহজলভ্যতা দেখে অনেকেই আশঙ্কা করছেন এটি ক্রমে মানবমেধার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এরফলে অনেকে কাজও হারাতে পারেন।
চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে অর্থ লাগে কি?
চ্যাটজিপিটি নিয়ে পরিপূর্ণ ধারণা যাদের নেই তারা মনে করতে পারেন এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশ ভালো অঙ্কের অর্থব্যয় করতে হবে। কিন্তু এই অ্যাপটি একেবারেই বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। অনেক অ্যাপ স্টোরে চ্যাটজিটিপি নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়ে প্রতারিত করা হচ্ছে। ওয়েব ব্রাউজারে গিয়ে সহজেই এটি ব্যবহার করা যায়।
মোবাইলে যেভাবে চ্যাটজিটিপি ব্যবহার করা যায়:
-মোবাইলে এই চ্যাটবটটি ব্যবহার করতে হলে প্রথমেই ওপেনএআইয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (https://openai.com/blog/chatgpt/) যেতে হবে।
-এই ওয়েবসাইটে যাওয়ার পর ‘ট্রাই চ্যাটজিটিপি’ নামে একটি অপশন দেখা যাবে। এই অপশনটিতে ক্লিক করতে হবে।
-প্রথমবারের মতো ওয়েবসাইটটিতে ক্লিক করলে সাইন আপ করতে হবে। এজন্য ব্যবহারকারির হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর অথবা ইমেইল আইডি ব্যবহার করতে হবে।
– একবার সাইন আপ হয়ে গেলে পরবর্তিতে লগ-ইন করলেই হবে।
-এভাবে চ্যাটবট ব্যবহার করা যাবে। লগইন করার পর একটি সার্চবার দেখা যাবে। এই সার্চবারে প্রশ্ন টাইপ করতে হবে।
– প্রশ্ন দেয়ার পর এন্টার চাপলেই উত্তর চলে আসবে। এখানে মজার বিষয় হলো যতক্ষণ চ্যাটবটকে থামার নির্দেশ দেয়া না হবে ততক্ষণ এটি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিতেই থাকবে।
ডেইলি মেইল, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, বিবিসি ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে