![]() |
বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটররা ইতোমধ্যে ফাইভজি প্রযুক্তির ট্রায়াল করেছে, যেখানে হুয়াওয়ে অন্যতম প্রযুক্তি অংশীদার।
দেশের এই মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ফাইভজির ব্যবহার খাত নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন হুয়াওয়ের এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ঝ্যাং ঝেংজুন। ব্যাংককে এমবিবিএফ ফোরোমে তাঁর সাক্ষাতকার নিয়েছেন টেকশহরের নির্বাহী সম্পাদক আল-আমীন দেওয়ান।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা, ডিজিটাল ইকোসিস্টেম এবং ডিজিটাল ভিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় ঝ্যাং ঝেংজুনের। তিনি সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় হুয়াওয়ে বাংলাদেশ টেকনোলজিসের সিইও ছিলেন।
টেক শহর : বাংলাদেশে ফাইভজি নিয়ে হুয়াওয়ে কী ভাবছে ?
ঝ্যাং ঝেংজুন : আমরা জানি এশিয়া প্যাসিফিকে ফাইভজি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে । দেখেন, প্রথম ফাইভজি চালু করেছে কোরিয়া ও জাপান । এরপর থাইল্যান্ডও বেশ বড় পরিসরেই ফাইভজি চালু করেছে, দেশটি এখনই তাদের ৭০ শতাংশ এলাকা ফাইভজি কাভারেজের মধ্যে নিয়ে এসেছে। আর ৩০ শতাংশ মানুষ এর সেবা পাচ্ছে।
আসলে ফাইভজির বিষয়টি প্রত্যেকটির সমাজের প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে। তাই প্রতিটি দেশের ফাইভজি চালুর পদক্ষেপ একইরকম হবে না।
হুয়াওয়ে বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ মেলায় অংশ নিয়েছিলো যেখানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে হুয়াওয়ের ফাইভজি প্রযুক্তিতে ইন্টারনেটের গতি ১ দশমিক ৬ জিবিপিএস পর্যন্ত উঠেছিলো। এছাড়া ফাইভজি হ্যান্ডসেটও দেখানো হয়েছিলো।
ফাইভজিতে শিল্পখাতসহ বাসাবাড়ির ক্ষেত্রে রিমোট বা দূর হতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন সেবাগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আইওটি সংযোগ প্রয়োজন। আর কম লেটেন্সি, বিশেষ করে শিল্পখাতে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এ ধরণের বিশেষ সুবিধাগুলো একেকক্ষেত্রে একেকভাবে মাননসই, সেটা বিভিন্ন সমাজ বা দেশের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি আমরা । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি যে, ভিডিও দেখা, টিকটক, ইউটিউব বা ফেইসববুক ব্যবহারে ফোরজিই যথেষ্ট।
এখানে এতো বড় জনসংখ্যার জন্য ভালো কাভারেজ নিশ্চিতে আরও টাওয়ার বা নেটওয়ার্ক সাইট প্রয়োজন। আমি বাংলাদেশে থাকাকালে সিলেট বা ময়মনসিংহ যেতে পথে ভালো সিগন্যাল পেতাম না, কখনও কখন টুজি আসতো আবার কখনও কখনও সিগন্যালও মিলতো না।
তাই, ফাইভজি দ্বিতীয় অপশন। বাংলাদেশে এখনও ফোরজির মৌলিক অবকাঠামো প্রয়োজন। তাই আরও বেশি ফোরজি কাভারেজ এবং সাইট করতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ মোবাইল ফোন অপারেটদের উৎসাহিত করছে আরও বেশি সাইট তৈরি এবং নেটওয়ার্ক কাভারেজ বাড়াতে যেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে নেটওয়ার্ক সেবা দেয়া যায়। এটি শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতেই নয় দেশের সকল শহর ও গ্রামঞ্চলে নিশ্চিত করতে হবে, যা ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে মোবাইল অপারেটরদের ফাইভজি স্পেকট্রাম দিয়েছে। ফাইভজি বেশি ব্যবহার হবে শিল্প এলাকায়। চীনে আমাদের অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন ফাইভজি হাসপাতালসহ বন্দর এলাকা, উৎপাদন শিল্প, খনি ইত্যাদিতে ফাইভজি ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এ ধরণের ব্যবহার খাতগুলো সামনে তৈরি হবে। চট্টগ্রামে ফাইভজির ব্যবহার নিয়ে বিশেষভাবে ভাবছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক শ্রমিক দীর্ঘ সময় কাজ করে, যারা সরাসরি অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি পরিচালনা করে। এখানে ফাইভজি চালু হলে ব্যাপক সংযোগ এবং কম লেটেন্সির কারণে শ্রমিকরা এসব যন্ত্রপাতি দূর হতে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পারবে । তাই এ ধরণের সুবিধাগুলো চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর এবং বিভিন্ন শহরের বিমানবন্দরগুলোর মতো শিল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ফোরজি ভালো তবে নি:সন্দেহে ফাইভজি আরও ভালো।
উৎপাদনের ক্ষেত্র দুটি উদাহারণ দেই, এক, আপনার যখন অ্যাসেম্বলিং লাইন থাকে, তখন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংযোগ করতে আপনার প্রচুর ক্যাবলের প্রয়োজন হয় । যেমন মোবাইল ফোন তৈরি করার সময়, ১০০ মিটারের বেশি উত্পাদন লাইনের প্রয়োজন হয় এবং এখানে প্রতিটি মেশিনকে একে অপরের সাথে সংযোগ করতে হবে।
এখন এই লাইনে একটি মডেল বা পণ্য উৎপাদনের পরে যখন আরেকটি মডেল বা পণ্য উৎপাদন করবেন তখন লাইনটি পুনরায় ডিজাইন করতে হবে। এরজন্য এক কিলোমিটারের মতো ব্যাপক পরিমাণ ক্যাবলিং করতে হবে। তাই প্রতিবার দুই সপ্তাহের সময় লেগে যাবে এই লাইন সাজাতে। ফাইভজি তারহীন, আর এরজন্য এই সময় লাগবে মাত্র একদিন। এতে সময় এবং টাকা দুটি সাশ্রয় হবে।
আবার বেশি ব্যান্ডউইথের জন্যই তো ফাইভজি । তাই এটি এইচডি ক্যামেরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অনেক বড় খাত। আমরা সুইং মেশিনে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ব্যবহার করতে পারি, উৎপাদন কেমন হচ্ছে তা পরীক্ষা করতে। এইচডি ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি করবে। এমন জায়গাগুলোতে এআই এবং ফাইভজি কাজে লাগতে পারে।
বন্দরের মতো জায়গা বা অনেক গরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হতে শ্রমিকদের নিরাপদে রাখা যেতে পারে ফাইভজিতে রিমোটলি কাজ করে। বিশেষত, চীনে, খনির শিল্পগুলো ভূগর্ভস্থ এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক ও নোংরা। এক্ষেত্রে ফাইভজি দিয়ে দূরে অফিস হতে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
টেক শহর : যেসব দেশে ফাইভজি চালু হয়েছে, সেখানে শিল্পখাতের ও সাধারণ ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা কেমন ? তাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা কোন দিকে যাচ্ছে ?
ঝ্যাং ঝেংজুন : শিল্পখাতের ব্যবহারকাীদের আগ্রহ বেশি। বিশেষ করে কোরিয়াতে, সেখানে খুব ভালো বিনোদন শিল্প গড়ে উঠেছে। মানুষ এইচডি ভিডিও এবং ভিআর উপভোগ করে, গেইমিং করে।
বিশেষ করে গেইমিংয়ের ক্ষেত্রে, অনলাইনে গেইম গেলতে গেলে ব্যাপক ব্যান্ডউইথ, উচ্চগতি, কম ল্যাটেন্সি এবং হাইডেফিনেশন ছবি-ভিডিওর জন্য ফাইভজি দারুণ। এই বিষয়গুলো তাদের ফাইভজি ব্যবহারে আগ্রহ তৈরি করে।
এখানে ব্যাংককে, আমাদের ফাইভজি আছে। আমি ফাইভজি ব্যবহার করছি। গতি অনেক দ্রুত, ডাটা ট্রাফিক অনেক ভালো। আমি ইতোমধ্যে বলেছি, বিভিন্ন শিল্পখাত এখন ফাইভজিতে আরও এবং আরও আগ্রহী হবে । কারণ তারা কর্মদক্ষতা বাড়ানো, খরচ কমানো এবং কর্মীদের কাজের উন্নত পরিবেশ দিতে ফাইভজি ব্যবহার করতে চাইছে।
আমার মনে হয়, অপারেরগুলোও ফাইভজি প্রমোট করতে চায়। কারণ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে টুজি হতে ফাইভজি নেটওয়ার্কের প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা নেটওয়ার্ক নির্মাণ, অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেখান ক্যাপেক্স এবং ওপেক্স উভয়ক্ষেত্রেই একটি বিশাল খরচ আছে। তাই অপারেটররা সব নেটওয়ার্ক বা সেবা একটি নেটওয়ার্কে দিতে চায়। কিছু দেশে থ্রিজি বন্ধ আছে, আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে ফোরজি এবং ফাইভজিতে আরও বেশি ফোকাস করবে। থাইল্যান্ডে এআইএসের মতো অপারেটররা ফাইভজি প্রমোট করে এবং ব্যবহারকারীদের ফোরজি হতে ফাইভজিতে নিতে চেষ্টা করে। কারণ ফাইভজিতে দক্ষতা ভালো হলে, আপনি আরও বেশি খরচ করতে পারেন আর অপারেটররাও রাজস্ব বেশি পেতে পারে।
টেক শহর : যেসব দেশ ফোরজি নেটওয়ার্ক বাড়াতে এখন কাজ করছে আবার ফাইভজিও এনেছে, এসব দেশের এখন করণীয় কী ?
ঝ্যাং ঝেংজুন : উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশকে ধরা যাক। প্রথম পরামর্শ হল ফোরজির ভালো ভিত্তি তৈরি করতে হবে। ফোরজির ক্ষেত্রে ধারাবাহিক নিরবিচ্ছন্ন খুব ভাল অভিজ্ঞতা এখনও প্রয়োজন। এখানে সরকার এবং অপারেটরদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে । কারণ গ্রামীণ এলাকায়, সত্যি কথা বলতে, সেখানে এতো সুবিধা নেই, কারণ আপনি একটি টাওয়ার স্থাপন করে নেটওয়ার্ক স্থাপন করলেও কিন্তু রাজস্ব খুব কম। তাই কীভাবে অপারেটরদের গ্রামীণ এলাকায় নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে উৎসাহিত করা যায় এবং কভারেজ ক্রমাগত এবং নির্বিঘ্ন করা যায়- এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দ্বিতীয়ত, ফাইভজির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম এবং ঢাকার মতো কিছু বেশি ট্রাফিক এলাকায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ সেখানে আমাদের হাইএন্ড ব্যবহারকারী রয়েছে। সেখানে অনেকে ফাইভজি হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে, যারা অনলাইন গেইমিং এবং ভিআর বা এআর ইত্যাদির মতো আরও ভাল অভিজ্ঞতা চায়। তাই কিছু শীর্ষ বা বড় শহরে, আমি মনে করি এই মানুষদের কাভার করার জন্য আমাদের ফাইভজি দরকার।
আর শিল্পের ক্ষেত্রে, যেমন আমি কিছু শিল্প উল্লেখ করেছি, আমরা চেষ্টা করতে পারি সেখানে দক্ষতা বাড়াতে এবং শিল্পগুলোকে ডিজিটাল করতে। সম্ভবত শুরুতেই দেশব্যাপী ফাইভজি চালু করতে হবে না। এটি আসলে চাহিদার উপর নির্ভর করে।