![]() |
আল-আমীন দেওয়ান : টাওয়ার শেয়ারিং কোম্পানি ইডটকোর ওপর অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে এসএমপি বিধিনিষেধ।
চলতি অক্টোবরের শুরু হতেই এই বিধিনিষেধ চলছে।
দেশের মোবাইল টাওয়ার খাতে এসএমপি নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়ার এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে এই এসএমপি ঘোষণা ও তা কার্যকরে। এরমধ্যে বেশিরভাগ সময় ইডটকোর বিভিন্ন তদবির-আবদার সমালাতে হয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে, যেখানে মালেয়েশিয়া সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাও ছিলো। এসএমপি বিধিনিষেধ পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে কয়েকবার।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘টাওয়ার শেয়ারিং খাতে এসএমপি কার্যকর করা হয়েছে। আমরা জোর করে কিছু চাপিয়ে দেই না, যেটা যুক্তিসঙ্গত সেটিই করা হয়। ইডটকোকে এসএমপি করা হয়েছে বাজারে মনোপলি ঠেকানো এবং সাম্যবস্থা রাখতে।’
বিটিআরসির ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র টেকশহর ডটকমকে বলেন, এখানে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, মালয়েশিয়ার মতো দেশ এখানে বিনিয়োগ করেছে। মালয়েশিয়ায় আমাদের শ্রমবাজার আছে। দ্বিতীয়ত, তারা টাওয়ার শেয়ারিংয়ে বিগ জায়ান্ট, হঠাৎ করে যদি কোনো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে নেটওয়ার্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। ফলে তারা যখন যেটা বলেছে সেটা আমলে নিয়েছি, সেগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে তার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে-এই জন্য এতো সময় লেগেছে।
‘তারা যেন বলতে না পারে তাদের কথা আমরা শুনিনি। তাদেরকে সময় দিয়েছি, সুযোগ দিয়েছি, তাদের কথা আমরা বারবার শুনেছি। কিন্তু যেটা ন্যায়সঙ্গত ও আইনসম্মত সেটাই করা হয়েছে’ বলছিলেন তিনি।
এসএমপির বিধিনিষেধ কার্যকর হওয়ার পর ইডটকোর কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চায় টেকশহর। ইডটকো কর্তৃপক্ষ টেকশহর ডটকমকে জানায়, ‘ইডটকোর পক্ষ হতে এখন কোনো মন্তব্য নেই।’
ইডটকোর যতো অনুরোধ-আবদার :
এসএমপি হিসেবে করণীয়-বর্জনীয় নির্ধারণ হওয়ার পর ইডটকো সর্বশেষ ৪ অনুরোধ করে। যেখানে, একসাথে একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ না করা, ‘বিড বুক’ অনুযায়ী প্রাথমিক ৫ বছরের প্রতিশ্রুতি অনুসারে স্বাভাবিক গ্রোথ ঠিক রাখতে বিক্রি, লিজ বা রোলব্যাকে বিধিনিষেধ দিয়ে শুরু করা, বিক্রি, লিজ বা রোলব্যাকে শতভাগ পর্যন্ত যেকোনো উচ্চ ক্যাপিং এবং ৩ হতে ৫ বছরের বেশি সময়সীমায় পর্যায়ক্রমে বেশি হতে কম হিসেবে নতুন টাওয়ার নির্মাণের ক্যাপিং ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের বিষয়গুলো ছিলো।
কোম্পানিটির এর আগের অনুরোধ ছিলো, মোবাইল অপারেটদের টাওয়ার রোলব্যাক করা আগে এসএমপির দরকার নেই। আর টাওয়ারের বাজার শেয়ার হিসেবে বাজারে যত টাওয়ার আছে সেটা ধরা উচিত, এখানে শুধু টাওয়ার কোম্পানিদের টাওয়ার ধরে বাজার শেয়ার নির্ধারণ ঠিক হবে না বলে মনে করেন তারা। বাজারে তিন-চারটি শক্তিশালী কোম্পানি থাকলে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা কম বলেও বলে তারা।
এসএমপি ঘোষণার প্রক্রিয়ার মধ্যে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারের সঙ্গে বৈঠক(অনলাইন) করেছিলেন বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাসিম ।
ওই বৈঠকে মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার বলেছিলেন, এসএমপি ঘোষণার মাধ্যমে ইডটকোর বিনিয়োগ হুমকির মধ্যে পড়বে। বিষয়টি নিয়ে মালয়েশিয়ান সরকারের উদ্বেগ রয়েছে এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে । এতে মালয়েশিয়ান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের টাকা ইডটকো লিমিটেডে বিনিয়োগ করা।
এছাড়া মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানান । সেখানে বাংলাদেশের টাওয়ার ব্যবসায় এসএমপি নির্ধারণের বিষয়ে সরাসরি উদ্বেগ প্রকাশ করে মালয়েশিয়া সরকার।
আবার দেশে আরেক মালেশিয়ান কোম্পানি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা বিটিআরসিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়াতে ভূমিকার জন্য প্রশংসাসূচক ডিও চিঠিও পাঠায় । এতে প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে অভিনন্দনও জানায় তারা। এতে রবি উল্লেখ করে, রবি আজিয়াটা মালয়েশিয়ান বিনিয়োগকারী হিসেবে ক্রমাগত বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। তারা এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে ইডটকোর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের ডিজিটাল অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবদান বাড়াবেন।
সর্বশেষ কার্যকর হলো যেসব বিধিনিষেধ :
নতুন টাওয়ার নির্মাণের ক্ষেত্রে :
মোবাইল অপারেটররা প্রতি ৬ মাস পরপর (জানুয়ারি ও জুলাই) পরবর্তী ৬ মাসে নতুন টাওয়ার স্থাপনের পরিকল্পনা বা চাহিদা বিটিআরসিকে জানাবে।
প্রথম ৬ মাসে সব অপারেটর হতে নতুন টাওয়ার স্থাপনের চাহিদা পাওয়ার পর সর্বমোট চাহিদার সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ প্রথম বছরে, ৩০ শতাংশ দ্বিতীয় বছরে এবং ২৫ শতাংশ তৃতীয় বছর হতে চলমান হারে ইডটকো নতুন টাওয়ার নির্মাণ করতে পারবে।
টাওয়ার কোম্পানিগুলোর নতুন টাওয়ার নির্মাণের সংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরদের দেয়া ওয়ার্ক অর্ডার বা পিও বিবেচনা করা হবে।
মোবাইল অপারেটরদের কাছে থাকা টাওয়ার বিক্রি বা লিজ বা রোলব্যাকের ক্ষেত্রে :
মোবাইল অপারেটররা প্রতি ৬ মাস পরপর (জানুয়ারি ও জুলাই) পরবর্তী ৬ মাসে টাওয়ার বিক্রি, লিজ বা রোলব্যাকের পরিকল্পনা বা চাহিদা বিটিআরসিকে জানাবে।
প্রথম ৬ মাসে সব অপারেটরের বিক্রি, লিজ বা রোলব্যাকের চাহিদা পাওয়ার পর সর্বমোট চাহিদার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ইডটকো পাবে। অবশিষ্ট নন-এসএমপি অপারেটরগুলো পাবে।
টাওয়ার কোম্পানিগুলোর কেনা, লিজ বা রোলব্যাকের সংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরদের দেয়া ওয়ার্ক অর্ডার বা পিও বিবেচনা করা হবে।
এছাড়া বিধিনিষেধে বলা হয়েছে, যেকোনো ৬ মাসে সব মোবাইল অপারেটরদের পরিকল্পিত টাওয়ার সংখ্যা (নতুন, বিক্রি, লিজ, রোলব্যাক) ওই ৬ মাস শেষে বাস্তবায়িত টাওয়ার সংখ্যার ভিত্তিতে পরবর্তী ৬ মাসে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের পরিকল্পিত টাওয়ার সংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
আর এই নির্দেশনা কার্যকরের আগে হওয়া কার্যাদেশ বা ক্রয়াদেশ নতুন বিধিনিষেধে গণ্য হবে না।
ইডটকোর মনোপলি :
দেশের টাওয়ার কোম্পানিগুলোর মোট টাওয়ার সংখ্যা হলো ১৬ হাজার ২৬৩টি।
সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইডটকোর টাওয়ার সংখ্যা ১৪ হাজার ১২১টি। এরমধ্যে পূর্ণ টাওয়ার ১৩ হাজার ৬০৯ টি, কাজ চলমান ৭৮ টি এবং কার্যাদেশ আছে কিন্তু কাজ শুরু হয়নি এমন ৪৩৪ টি টাওয়ার।
সামিটের টাওয়ার রয়েছে ১ হাজার ৩৩৬টি। এরমধ্যে পূর্ণ টাওয়ার ১ হাজার ৩ টি, কাজ চলমান ২৫৭ টি এবং কার্যাদেশ আছে কিন্তু কাজ শুরু হয়নি এমন ৭৬ টি টাওয়ার।
কীর্তনখোলার আছে ৪১২ টি। এরমধ্যে পূর্ণ টাওয়ার ৩১৪ টি, কাজ চলমান ৭৭ টি এবং কার্যাদেশ আছে কিন্তু কাজ শুরু হয়নি এমন ২১ টি টাওয়ার।
এবিহাইটেকের টাওয়ার সংখ্যা ৩৯৪টি। এরমধ্যে পূর্ণ টাওয়ার ২১০ টি, কাজ চলমান ১৮৪ টি টাওয়ারের।
হিসাব বলছে, মোট টাওয়ার সংখ্যার ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ দখলে ইডটকোর, ৮ দশমিক ২১ শতাংশ দখলে সামিটের, ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ দখলে কীর্তনখোলার এবং ২ দশমিক ৪২ শতাংশ দখলে এবিহাইটেকের।
এবার দেখা যাক, রাজস্ব আয়ের মানদণ্ডে কে কোথায়?
২০১৮ সালের নভেম্বর হতে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সময়ে ইডটকো আয় করেছে ৪ হাজার ১৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
সামিট আয় করেছে ৫০ কোটি ৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, কীর্তনখোলা ৮ কোটি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার এবং এবিহাইটেক ১৩ কোটি ২৪ লাখ ৮ হাজার টাকা।
দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আয়ে ইডটকোর বাজার দখল ৯৮ দশমিক ২৪ শতাংশ, সমিটের ১ দশমিক ২৩ শতাংশ, কীর্তনখোলার ০ দশমিক ২১ শতাংশ এবং এবি হাইটেকের ০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলছে, টাওয়ার কিংবা রাজস্ব উভয় দিকেই বাজারে ইডটকো অস্বাভাবিক মনোপলি করছে।
টেলিযোগাযোগ খাতের প্রথম এসএমপি কোম্পানি হলো গ্রামীণফোন। আর দ্বিতীয় কোম্পানি হিসেবে এসএমপিতে পড়লো ইডটকো ।