![]() |
আল-আমীন দেওয়ান : নতুন বাজেটে মোবাইল ফোনে ভ্যাট আরোপের ফলে এ খাতের বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কায় দেশে কারখানা স্থাপনকারীরা ।
মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজার সংকুচিত হওয়া, কর্মসংস্থান হারানোসহ ডিজিটাল বাংলাদেশের গতি বাধাগ্রস্ত হবে বলেও বলছেন তারা।
খাতটির উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, বৈদেশিক মুদ্রার দাম বাড়ার কারণে এমনিতেই ১০ হতে ১৫ শতাংশ দাম বেড়েছে হ্যান্ডসেটের। আর নতুন করারোপে বাড়বে আরও ১৫ হতে ২০ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেখা যাবে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে পণ্যটি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইলে ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিপণনের কয়েক ধাপে ভ্যাট আরোপ হবে।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( এমআইওবি) জানায়, দেশে ১৪ টি মোবাইল হ্যান্ডসেট কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের এই কারখানাগুলোতে স্মার্টফোন চাহিদার ৯০ শতাংশ এবং ফিচার ফোন চাহিদার ৭০ শতাংশ সংযোজন-উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ইতোমধ্যে এ ভ্যাট প্রত্যাহারসহ বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে এনবিআররের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছে মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( এমআইওবি)।
আর উদ্যোক্তা ও এ খাতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ ভ্যাট প্রত্যাহারে অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরকে ‘জিও লেটার’ দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
মোস্তাফা জব্বার টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘এটা আমি এনবিআর চেয়ারম্যান এবং অর্থমন্ত্রীকেও বলেছি যে, সব জিনিসকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। এই মুহূর্তে দেশের মোবাইলের পেনিট্রেশন জরুরি, সে কারণে এই ভ্যাটকে কোনোভাবেই সমর্থন করি না।’
‘ইতোমধ্যে জানিয়েছি, জিও লেটার দেয়া হয়েছে প্রত্যাহার করার জন্য। আশাকরি তারা বিবেচনা করবে।’ উল্লেখ করেন তিনি।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( এমআইওবি) এর সহ-সভাপতি রেজওয়ানুল হক টেকশহর ডটকমকে জানান, ‘প্রান্তিক ব্যবসায়িক ভ্যাট সংগ্রহ দু:সাধ্য কাজ। এতে অনেক অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হবে যা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে। এছাড়া অবৈধ পথে আসা মোবাইলের দামে সঙ্গে পেরে উঠবে না স্থানীয় কারখানাগুলো। এতে বাংলাদেশে স্থাপিত স্থানীয় কারখানাগুলো বিশাল বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে।
রেজওয়ানুল হক কার্লকেয়ার টেকনোলজি এবং ট্রানশান বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী। তিনি দেশে টেকনো ও আইটেল ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক।
তিনি টেকশহরডটকমকে বলছেন, দেশের কারখানাগুলোতে ১০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান রয়েছে । তাদের কর্মমসংস্থান ঝুঁকির মুখে পড়বে।
শাওমি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউদ্দিন চৌধুরী টেকশহর ডটকমকে জানান, ‘বর্তমানে সারাবিশ্বে চলমান নানা রকম অর্থনৈতিক অস্থিতিকর পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মূদ্রার উর্ধমূখী মূল্যায়নে ইতোমধ্যেই দেশের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মতো মোবাইল ফোনের দামেও প্রায় ১০ হতে ১৫ শতাং প্রভাব পড়েছে।’
‘বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবসায় প্রতিটি ব্র্যান্ডের জন্য ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ৩ হতে ৪টি স্তরে ব্যবসা সম্পন্ন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যদি মোবাইল ফোন ব্যবসার প্রতিটি স্তরে উপরোক্ত ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয় তবে প্রতিটি মোবাইল ফোনের খুচরামূল্য প্রায় ১৫ হতে ২০ শতাংশ বাড়বে। এতে ব্যবসার স্তর কমানোর প্রবণতার কারণে প্রচুর পরিমাণে বেকারত্ব তৈরি হবে।’ উল্লেখ করেন তিনি।
জিয়াউদ্দিন জানান, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোনের শিল্পে আমদানি পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের এই. এস. কোডে পরিবর্তন আসায় অতিরিক্ত ২ হতে ৩% অগ্রিম আয়কর দিতে হবে। এখন সব মিলে যদি মোবাইল ফোনের দাম ২০ হতে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় সেক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হবে এবং মোবাইল ফোন দেশের সিংহভাগ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।’
ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন টেকশহর ডটকমকে জানান, ‘উৎপাদন পর্যায়ে কারখানাগুলো (দুটি ছাড়া) ৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে আসছে। যার সামগ্রিক পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা।’
ফেয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্স বাংলাদেশে স্যামসাং মোবাইল ফোন ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের পরিবেশক ও উৎপাদক।
ব্যবসায়ী পর্যায়ে নতুন এই ৫ শতাংশ করারোপে অন্যান্য উদ্যোক্তাদের মতোই উল্লেখিত সমস্যা ও ঝুঁকির কথা বলছিলেন ফেয়ার গ্রুপের এই শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ।
তিনি বলেন, ‘এই ভ্যাটে আগে যদি ১৫ হাজারে একটি হ্যান্ডসেট গ্রাহক কিনতেন সেটি এখন ১৮ হতে১৯ হাজার কিনতে হবে , আরও বেশি দামের ক্ষেত্রে আরও বেশি। স্বাভাবিকভাবেই স্মার্টফোন প্রেনিট্রেশনে তার প্রভাব প্রবলভাবে পড়বে। দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। এই ভ্যাটে মোবাইলের বাজার সংকুচিত হবে।’
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( এমআইওবি) এর বিকল্প প্রস্তাব :
ব্যবসায় পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে এর পরিববর্তে কারখানা পর্যায়ে অগ্রিম ব্যবসায়িক ভ্যাট আদায়ের একটি প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি ।
এনবিআরকে দেয়া চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছেন, ‘সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কারখানা হতে উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধের পর ব্যবসায়ী পর্যায়ে যত মূল্য সংযোজন হবে, তা অগ্রিম প্রাক্কলন করে ওই মূল্য সংযোজনের উপর ১৫ শতাংশ হারে কারখানা হতে আদায় করা যেতে পারে।
সংগঠনটির সদস্য কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক পর্যায়ে গড় মূল্য সংযোজন প্রায় ১২ শতাংশ। এর উপর ১৫ শতাংশ ব্যবসায়ী ভ্যাট আদায়ের কথা বলছেন তারা। হিসাবে যা ১ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়, এই পরিমাণ অগ্রিম ব্যবসায়িক ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব এনবিআরকে দিয়েছেন তারা।
এছাড়া ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার বা এনইআইআর সিস্টেম এনবিআর যাচাই-বাছাই করে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও তারা দেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিক-নির্দেশনায় সরকার মোবাইল ফোন উৎপাদনে এবং মোবাইল যন্ত্রাংশ আমদানিতে ব্যাপক শুল্ক ছাড়সহ নানা সুবিধা দেয়। বিপরীতে হ্যান্ডসেট আমদানিতে শুল্ক বাড়ায়। ফলে স্থানীয়ভাবে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোর কারখানার করার হিড়িক পড়ে যায়।
দেশে কারখানা করা উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো হলো ওয়ালটন, সিম্ফনি, স্যামসাং, আইটেল-ট্র্যানসান ও ফাইভস্টার। এই পাঁচ কোম্পানির পরে লাভা, ওকে মোবাইল, উইনস্টার, ভিভো, অপো, রিয়েলমি, নোকিয়া, শাওমি ।