![]() |
আল-আমীন দেওয়ান : ‘এটা দাসত্ব, বাংলাদেশে বসে একটি বৈশ্বিক কোম্পানি কর্মীদের সঙ্গে এমন আচরণ করছে এটা ভাবাই যায় না।’
অপোর বাংলাদেশ অফিসের কর্মী ব্যবস্থাপনা বিধিমালা দেখে এমনটাই বলছিলেন ইউনি গ্লোবাল ইউনিয়নের গ্লোবাল আইসিটি কমিটির সদস্য মিয়া মো. শফিকুর রহমান মাসুদ।
ইউনি গ্লোবাল শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন, যারা ১৫০ দেশে কাজ করে।
মাসুদ গ্রামীণফোন পিপলস কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান ও অ্যাপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বলছিলেন, কথায় কথায় জরিমানা, ছুটিতেও বেতন কেটে নেয়া আবার বেতন না দেয়া, অসুস্থতা ছুটি নিয়ে রোগ-অসুখ নির্ধারণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম কর্মীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ। যেন দাসত্ব চালাচ্ছে অপো, আইন ভাঙার মচ্ছব ।
‘এগুলো শুধু শ্রম অধিকার লঙ্ঘন নয়, কর্মক্ষেত্রে এক ধরনের মানসিক নির্যাতনের মধ্যেও পড়ে। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে অপোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত’ বলছিলেন তিনি।
সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে অপো বাংলাদেশ অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি এবং যৌন পৗড়নের অভিযোগও, লিগ্যাল নোটিশও দিয়েছেন সাবেক একজন কর্মী। এছাড়া অপোর একজন উর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তা সম্প্রতি চাকরি ছেড়েছেন এই জন্য যে, তার বিভাগে তারই এক সহকর্মীর জন্য অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো।
এরমধ্যেই বের হয়ে এলো অপো বাংলাদেশ অফিসে ‘স্টাফ ম্যানেজমেন্ট রেগুলেশন (ভিইআর৬.০)’ নামে কর্মী ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করে বিভিন্নভাবে কর্মী অধিকার লঙ্ঘন, মানসিক নির্যাতন ও বাংলাদেশের শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখার ঘটনা। যে রেগুলেশন কোনোভাবেই অনুমোদিত নয় বলে নিশ্চিত করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ।
এই রেগুলেশন এবং তা দিয়ে কর্মীদের সঙ্গে শ্রম আইনের বাইরে আচরণ করা নিয়ে অপোর সাবেক-বর্তমান বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে টেকশহর ডটকম। অনেকে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। তারা নিজেদের অসহায় ও নিরুপায় অবস্থার কথা বলছিলেন।
অপো বাংলাদেশের এই শ্রম আইন না মানা, কর্মী নির্যাতনমূলক বিধিমালার প্রতিবাদ করে প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ পর্যায়ের এক বাংলাদেশী কর্মকর্তার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, ২০১৬ সালের আগে অপো বাংলাদেশ অফিসে ক্যাজুয়াল লিভ, সিক লিভ, অ্যানুয়াল লিভ এগুলো কিছুই অপোতে ছিলো না। এরপর নানা কঠিন অবস্থার বিপরীতে একটি বিধিমালা তৈরির কাজ শুরু হয় যা ২০১৭ সালের নভেম্বরে অ্যাপ্রুভ হয় । যেটা মোটামুটি লেবার ল মেনেই।
‘কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে অপো বাংলাদেশের চায়নিজ কর্মকর্তারা নতুন আরেক বিধিমালা করতে শুরু করে। ২০২২ এসে যেটা জানুয়ারিতে ইমপ্লিমেন্ট করা হলো। আর এই পলিসি বাস্তবায়ন করেছেন অপো বাংলাদেশের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার এলেক্স এবং অনুমোদন দিয়েছেন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডেমন ইয়াং।’ বলছিলেন তিনি।
অপোর একাধিক কর্মী এটা নিশ্চিত করেছে যে, কোনো নোটিশ ছাড়াই বিধিমালাটি কর্মীদের উপর কার্যকর করা হয়। ফলে কেউ কেউ স্যালারি কম পাচ্ছে দেখে বাংলাদেশী কর্মীরা বিষয়টি জানতে চাইলে এলেক্স বলেছেন, এটা তাদের (কর্মীদের) কনসার্ন না।’
‘আর এমডি ডেমন ইয়াং বলেছেন, দুই বছর আগের বিধিতে কোম্পানির কস্টিং বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, এমপ্লয়িদের বেনিফিটেড করা হয়েছিলো। কিন্তু মিস্টার এলেক্স কোম্পানির কথা চিন্তা করছে, কোম্পানি মেক স্মুদার এন্ড বেটার এন্ড হি হিজ অপটিমাইজড দ্যা কস্ট।’ জানান এই বিধিমালা নিয়ে আপত্তি জানানো ওই কর্মকর্তা।
এই বিধিমালাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংবাদ জিজ্ঞাসার জন্য টেকশহরের পক্ষ হতে যোগাযোগ করা হয় অপো বাংলাদেশের সঙ্গে ।
বিস্তারিত জানানো হয় অপো বাংলাদেশের ডিরেক্টর (এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স এন্ড এডমিন) ওয়াং লি এর সঙ্গে, যিনি জেনি নামে বাংলাদেশে পরিচিত।
তিনি জানান, এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।
শেষে অপো বাংলাদেশের পক্ষে ব্লাকবোর্ড স্ট্র্যাটেজিস এশিয়াটিক ৩৬০ গত ১০ মে ২০২২ তারিখে একটি বক্তব্য পাঠায়।
তাদের মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে অপো জানায় ‘আমাদের এইচআর পলিসি নিয়ে যে বিভ্রান্তি (তথ্য গোপন, হয়রানি, বেতন কর্তন) তৈরি হয়েছে তা দূর করতে আমরা আমাদের এইচ আরপলিসি পুনর্বিবেচনা করছি। প্রতিটি কর্মীর বিকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করতে অপো সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এ বিষয়টি বিবেচনা করেই, অপো শ্রম আইন ও অন্যান্য আইনের সাথে প্রতিষ্ঠানের অসঙ্গতি নিরসনে (যদি পাওয়া যায়) এইচআর পলিসি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের নতুন এইচআর পলিসি অচিরেই কার্যকর হবে।’
স্টাফ ম্যানেজমেন্ট রেগুলেশনের (ভিইআর৬.০) উল্লেখযোগ্য কিছু নিয়মকানুন :
২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি ইস্যু করা অপোর ওই বিধিমালার পার্ট-৭. লিভ ম্যানেজম্যান্টে বলা হয়েছে, ক্যাজুয়াল লিভ, সিক লিভ, ম্যাটারনিটি লিভ, ফেস্টিভাল লিভ, অ্যানুয়াল লিভের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বেসিক বেতন দেয়া হবে। এখানে অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা মিলবে না।
সিক লিভ বা অসুস্থতাজনিত ছুটির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কারও যদি এ ক্ষেত্রে ৩ দিনের বেশি ছুটি লাগে তাহলেই কেবল তা অসুস্থতাজনিত ছুটি হিসেবে বিবেচিত হবে। এর কমে অসুস্থতা থাকলে অসুস্থতা ছুটি মিলবে না।
কর্মীরা প্রবিশন পিরিয়ড থাকাকালীন সময়ে অসুস্থতা ছুটি পাবে না। প্রবিশন পিরিয়ড শেষ অসুস্থতার ছুটির জন্য আবেদন করা যাবে তবে তা শুধু বড় ধরনের অসুস্থতা হতে হবে, ইনজুরি হতে হবে বা হাসপাতারে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টে থাকতে হবে।
আর যদি অসুস্থতাজনিত ছুটি ১৪ দিন ছাড়িয়ে যায় তাহলে সেটা বিনা বেতনের ছুটি হিসেবে বিবেচিত হবে যা অ্যানুয়াল লিভের সঙ্গে সমন্বয়ের কোনো সুযোগও পাবে না কর্মী।
অ্যানুয়াল লিভের ক্ষেত্রে ১ বছরের বেশি আবার ৩ বছরের কম চাকরির বয়সে ৫ দিন, ৩ বছরের বেশি ও ৫ বছরের কম হলে ১০ দিন এভাবে স্লট করা হয়েছে।
‘বিভাগীয় ব্যবস্থাপক বা ডিপার্টমেন্টার ম্যানেজাররা কর্মীদের উপস্থিতি রিপোর্ট প্রতি মাসের প্রথম তারিখের জমা দিতে ব্যর্থ হলে শাস্তি হিসেবে তাদের প্রতি দিনের জন্য ১ হাজার টাকা জরিমানা বা চার্জ দিতে হবে।
উপস্থিতি প্রতিবেদনে কোনো ভুল করলে তা যদি ৩ বারের কম হয় তাহলে প্রতি ভুলের জন্য ১০০ টাকা, এর বেশি হলে প্রতি বারের জন্য ১০০ টাকার সঙ্গে আরও ৩২৫ টাকা যোগ হবে।
কোনো কর্মী অফিসে যদি তার আইডি পাঞ্চ করতে ১৫ মিনিট দেরী করেন (সকাল ৯টার পরে ও সন্ধ্যা ৬টার আগে) সেটা লেটনেস বা আর্লি লিভ হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে প্রথমবার ১০০ টাকা কাটা হবে আর তিন বারের বেশি হলে একদিনের বেসিক স্যালারি কাটা যাবে। এছাড়া দেরি করা বিষয়ে নানা ভাবে জরিমানার কথা বলা হয়েছে, সেখানে যাই হোক তা কোনো বিশেষ বিবেচনা না করার কথা বলা হয়েছে।
২১ পেইজেই ওই বিধিমালার দেখে ইউনি গ্লোবাল ইউনিয়নের গ্লোবাল আইসিটি কমিটির সদস্য মিয়া মো. শফিকুর রহমান মাসুদ বলেন, এর পরতে পরতে আইনভঙ্গ ও মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
আইন না মানলে ছাড় নয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী :
বাংলাদেশে বিদেশি তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম খাতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন-কানুন মানার ক্ষেত্রে সবসময়ই সোচ্চার ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। মূলত তাঁর প্রচেষ্টায়ই ফেইসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হতে সরকার রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের আইন, আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং নিয়মনীতির বিষয়ে তিনি কোনো ছাড় দেবেন না।
অপোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম-বেআইনি কার্যক্রমের প্রসঙ্গ জানালে তিনি বলেন, ‘আমার জনগণের স্বার্থ যা আছে তা আমাকে দেখতে হবে। এটা আমার জন্য অব্যশই একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। এখানে কোনো ছাড় নেই।’
অপো শ্রম আইনের ভায়োলেশন করছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক :
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান টেকশহর ডটকমকে জানান, অপো যেটা করেছে এটা অবশ্যই অনুমোদন নেই। কারণ শ্রম আইনের ভায়োলেশন করে অনুমোদিত হতে পারে না, এটা সম্ভব না। অপো শ্রম আইনের ভায়োলেশন করছে।
তিনি বলেন, কেউ অনুমোদন না নিয়ে থাকলে সে আইন অনুযায়ী চলছে না। এসব ক্ষেত্রে অধিদপ্তর হতে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যাওয়া হয়। শ্রম আইনের ধারা অনুযায়ী শ্রম আইনে মামলা হতে পারে।
হাফিজুর রহমান জানান, নিজস্ব বিধিমালা করলে সেটা কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে। এর বাইরে ওই বিধিমালা যদি শ্রম আইনের চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধার হয় তাও বেআইনি।
তিনি জানান, বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এবং সংশোধিত ২০১৫ অনুযায়ী যে সকল প্রতিষ্ঠান বা কারখানা সেটা দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠান বা দেশের হোক না কেনো সেটা বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগ-পরিচালনা শ্রম আইন অনুযায়ী হতে হবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তা যদি নিজস্বভাবে কিছু নীতিমালা করতে চায় তা করতে পারবে তবে শর্ত আছে যে তা ওই নীতিমালা বা বিধি শ্রম আইনের থাকা সুযোগ-সুবিধা হতে কম হতে পারবে না, হলে তা বেআইনি।
‘ক্যাজুয়াল-ব্যক্তিগত লিভ, সিক লিভসহ কোনো ছুটির ক্ষেত্রেই কোনোরকম টাকা কাটা যাবে না। এটা হতেই পারবে না ’ বলছিলেন তিনি।
এই শ্রম পরিদর্শক জানান ‘যদি কেউ দেরি অফিসে গেলো না শুধু, যদি কেউ একদিন অফিসে আসলো না বা দুই দিন আসলো না তখন তাকে আগে নোটিশ করতে হবে যে কী কারণে, সে যদি সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারে তাহলে তাকে আরও নোটিশ করতে হবে।
‘কোনো ক্ষেত্রেই হুটহাট জরিমানা করার কোনো সুযোগ নেই’ জানান তিনি।
হাফিজুর রহমান জানান, বছরে অ্যানুয়াল লিভে প্রতি ১৮ দিনে একদিন বাৎসরিক ছুটি পাবে। তার মধ্যে অর্ধেক সে নগদায়ন করতে পারবে মানে টাকা পাবে আর অর্ধেক সে কাটাতে পারবে । এটি না মানলে আইনের ব্যত্যয় হবে।
তিনি জানান, শ্রম আইনে সপ্তাহে দেড় দিন ছুটির কথা বলা আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে, সেটা কেউ এক দিন করে বিধিমালা করতে পারবে না। আবার কারখানায় একদিন ছুটি। কেউ যদি বলে সেটা হাফবেলা করে বিধিমালা করবে সেটা পারবে না। শ্রম আইনে মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া আছে ১৬ সপ্তাহ (আগে ৮ ও পরে ৮ সপ্তাহ), এখন কেউ যদি বলে ৬ সপ্তাহ করে দেবো সেটা পারবে না।
চাইনিজ তো চাইনিজ ই। এরা বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট নির্যাতন চালাচ্ছে আর কি।
শুধু অপো কেনো? বাংলাদেশে থাকা চাইনিজ গার্মেন্টস, নির্মাণ কাজ এসব সেক্টরেও চাইনিজরা জুলুম করেই যাচ্ছে।