![]() |
বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এবং বাংলাদেশ ওমেন ইন আইটি (বিডব্লিউআইটি)-র উদ্যোগে ২২ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ‘লুনা শামসুদ্দোহা গার্লস ইন আইসিটি উইক ২০২২’ শীর্ষক একটি আয়োজন। ২২-২৮ এপ্রিল নানা আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে এবং প্রতিদিন একজন সফল নারীকে নিয়ে বিশেষ ফিচার প্রচারিত হবে। এ আয়োজনের অন্যতম সহযোগী টেকশহরডটকম। আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে থাকছে গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং উদ্যোক্তা আফসানা হোসেন সেতু’র কথা।
‘কাজ শুরুর প্রথম মাসে আমার প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হয়। এটা তখন আমার কাছে অনেক বড় একটা পাওয়া ছিল। কারণ সেই সময়ে ঘরে বসে দশ হাজার টাকা আয় মানে বিশাল কিছু।’ ২০১৬ সালে নিজের আয়ের বিষয়ে এভাবেই জানালেন প্রফেশনাল গ্রাফিক্স ডিজাইনার এবং উদ্যোক্তা আফসানা হোসেন সেতু। প্রথম সে আয়ের পরেই ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস ফাইভার সাফল্য শুরু হয় সেতুর। দুই মাসেই লেভেল টু সেলার হয়ে যান তিনি এবং এক বছরে প্রায় তিন লক্ষ টাকা আয় করেন। সেই শুরুর পর থেকেই নিজের গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জানালেন, কাজের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকম অনলাইন এবং অফলাইন কোর্সের মাধ্যমে নিজেকে ডেভেলপ করার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত।
লালমনিরহাট জেলার দু্রাকুটি গ্রামে জন্ম আফসানা হোসেন সেতুর। প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা আর ২০১৬ সালের মতো সময়ে আইটি বা অনলাইনে আয় করা যায় এই বিষয়গুলো তখনোও গ্রামে অনেকটা স্বপ্নের মতো ছিল। তবে এই খাতে আসার পিছনে তার যে গল্প সম্পর্কে সেতু জানান, ‘আমি পড়াশুনাতে ছোটবেলা থেকেই ভালো ছিলাম। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম । আর আমার স্কুল থেকে আমিই প্রথম বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্রী ছিলাম। পরবর্তীতে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। যেহেতু শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে এবং গ্রামে ভালো শিক্ষক নেই তাই টিউশনি পড়তে যেতে হতো প্রায় ৬ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে। স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়ার। মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু চান্স পাইনি আর কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য পর্যাপ্ত অনুশীলন বা প্রস্তুতিও নিতে পারিনি। পরিবারও তেমন একটা সাপোর্ট দেয়নি। এক বছর পিছিয়ে থেকে পরেরবার চেষ্টা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই।’
অনেক পরিশ্রমের পরেও ভালো গাইডলাইনের অভাবে নিজের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় মানসিক ভাবে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সেতু। সেটি কাটিয়ে উঠতেই ভাবলেন নিজেই অনলাইনে কিছু করবেন। বললেন, ‘তখন আমাদের এলাকায় হাতে গোনা কয়েকজন ফ্রিলান্সিংয়ের মাধ্যমে করা যায় এমন কাজ শিখছে। বাবাকে বলার পরে বাবা আমাকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেয় এবং আমি একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হই।’ প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়েই এক মাসের মাথায় কাজের অগ্রগতি দেখে প্রশিক্ষক ফ্রিল্যান্সিংয়ের আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস ফাইভারে একটা আইডি খুলে দেন সেতুকে। বিষয়টি উল্লেখ করে সেতু জানালেন, ‘আইডি খোলার পর থেকেই শুরু হয় আমার গুগলে রিসার্চ করার কাজ। যে বিষয়গুলো আমি প্রশিক্ষণ থেকে শিখেছি তার থেকে অনেক বেশি বিষয় আমি গুগল থেকেই শিখেছি। কিভাবে মার্কেটিং করতে হয়, কিভাবে ক্রেতা বা যিনি কাজ দিচ্ছেন তাদের সামলাতে হয় ইত্যাদিও শিখেছি। আর গ্রামে যে নেটওয়ার্কের অবস্থা এমনও সময় গেছে শীতের রাতে সারারাত বাড়ির উঠোনে বসে কাজ করতে হয়েছে।’
কাজকে কখনো পেছনে না রেখে সামনেই রেখেছেন আফসানা হোসেন সেতু। প্যাশন এবং প্রফেশন হিসেবেই নিজের সংসার ও বাচ্চা সামলে নিজের উদ্যোগ সামলাতে অনেক কষ্ট হলে কাজ চালিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। সেই প্যাশন এবং গ্রাফিক ডিজাইন, ব্রান্ড আইডেন্টিটি এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট শিল্পে দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে ২০২০ সালের ডিসেম্বর এর দিকে ‘ডিজাইন ম্যানিয়াক’ নামে আমি একটি উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। শুরুর দিকে গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং ওয়েবসাইট টেম্পলেট নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে কর্পোরেট ব্রান্ড আইডেন্টিটি, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ই-কমার্স সার্ভিস এবং সব রকম প্রিন্ট আইটেম সরবরাহ করছেন নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে। নিজের প্রতিষ্ঠানে এখন তিন জন কর্মী নিয়ে ইতিমধ্যে ৩৫০ বেশি অধিক উদ্যোক্তাদের ব্রান্ড আইডেন্টিটি এবং প্রিন্টিং নিয়ে কাজ করেছেন সেতু। জানালেন, ‘আমি ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত আছি গত বছরের আগস্ট থেকে এবং ইতোমধ্যে উইয়ের প্রায় ২০০ জন উদ্যোক্তাকে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাফিক্স এবং প্রিন্ট রিলেটেড সল্যুশন দিয়েছি।’ উইয়ের সাথে কাজ করছি নিয়মিত আর খুব অল্প সময়ে উই-এর লাখপতির খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি। এবার লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫০ জন সদস্য সম্বলিত একটি টিম গঠন করা এবং যেটি একটি নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হবে এবং যার বাৎসরিক টার্নওভার থাকবে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা।
পাশাপাশি ডিজাইন ম্যানিয়াক স্কুল নামের একটি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট তৈরিরও স্বপ্নের কথা জানিয়ে সেতু বললেন, ‘এ ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে নারীদের আইটি সেক্টরে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যারা এফ কমার্স নির্ভর বিজনেস করে তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকবে। ইতিমধ্যে ছোট পরিসরে কাজ শুরুও করেছি।’
/জিপিডাব্লিউ/জেএ/এনসি