![]() |
টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর: ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রের তলদেশ থেকে ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূকম্পের কারণে সৃষ্ট সুনামী ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল লন্ডভন্ড করে দেয়। এ সুনামী ভারত মহাসাগরের চারপাশের জীববৈচিত্র ধ্বংস করে। প্রাণ হারায় কয়েকটি দেশের দুই লাখ ২৫ হাজার মানুষ। আগাম সতর্কবার্তা না পাওয়াই এই বিপুল প্রাণহানির অন্যতম কারন।
জোয়ার-ভাটা এবং ভূমিকম্পের সেন্সরের মতো স্থানীয় সতর্কবার্তাগুলো স্পষ্ট কোন সতর্কতা সৃষ্টি করতে পারে নি। বরং দেখা গিয়েছে যথাযথভাবে দেখভাল না করার কারণে অনেক সেন্সরই অকেজো হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে অনেক উপকূলীয় অঞ্চলেই সুনামী সাইরেন সতর্কতা ব্যবস্থা নেই। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারনে সঠিক সময়ে সতর্কবার্তা পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে মোবাইলে সতর্কবার্তা সহকারে পাঠানো বার্তা পৌঁছায় না অথবা অনেকে তা দেখারও সময় পায় না।
তবে সুনামীতে সমুদ্রের পানি ৯ মিটার (৩০ ফুট) উঁচু হয়ে সমুদ্রে আছড়ে পড়ার আগে কিছু কিছু প্রাণী আসন্ন বিপদ টের পায় এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রতক্ষ্যদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ি , হাতিগুলো জোড়ে জোড়ে ছুটতে থাকতে, ফ্ল্যামিঙ্গোরা নিচু জায়গার বাসা ছেড়ে উড়ে যাচ্ছিলো এবং কুকুরগুলো বাইরে যেতে চাইছিলো না। থাইল্যান্ডের উপকূলবর্তী গ্রাম ব্যাং কোয়ের বাসিন্দারা জানিয়েছিলো সমুদ্রের কাছে থাকা মহিষের একটি পাল হঠাৎ করে কান খাড়া করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলো এবং সুনামী আঘাত হানার কয়েক মিনিট আগে মহিষগুলো পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের উপরে উঠে যায়।
জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ডিজাস্টার রিস্ক (ইউএনআইএসডিআর) এর উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য এবং বর্তমানে জার্মান ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজির গবেষক ইরিনা রাফলিয়ানা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভূমিকম্প আঘাত হানার কিছুক্ষন পর এবং সুনামী আসার আগে গরু, ছাগল, বিড়াল এবং পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীকে অস্থিরভাবে দৌড়াতে দেখা গিয়েছে। বিপর্যয়ে বেঁচে থাকা অনেকেই এইসব প্রাণীদের সঙ্গে দৌড়ে নিজেদের রক্ষা করেছেন।’
রাফলিয়ানা তার ফিল্ড ওয়ার্কের সময় দেখা অন্যান্য দুর্যোগের ঘটনাও বর্ননা করেছেন। যেমন ২০১০ সালে সুমাত্রার কাছে ভূমিকম্প থেকে সমুদ্র তলদেশে সৃষ্ট সুনামীতে মেনতাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ৫০০ মানুষ প্রাণ হারান। এখানেও হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী এ ধরনের দুর্যোগের আভাস আগেই পেয়েছিলো।
মাত্র কয়েকদিন আগে জানুয়ারিতে টোঙ্গায় আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের দুইদিন আগে কচ্ছপগুলো হঠাৎ উল্টো দিকে চলছিলো।
নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে এমন অনেক অঞ্চলেই কোন আগাম সতর্কবার্তা দেয়ার ব্যবস্থা নেই। ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যল অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, দুর্যোগ প্রবণ হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ১০০ টি দেশের পর্যাপ্ত আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা নেই। তবে দুর্যোগের আগে প্রাণীদের আচরনের বিষয়গুলো যাচাই করে বেশ কয়েকজন গবেষক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পৌঁছেছেন যে প্রাণীদের অর্ন্তনিহিত ব্যবস্থা থাকে যা তাদেরকে আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সতর্ক করে। এদিক থেকে তাদের মধ্যে একটি প্রশ্ন তৈরি করেছে- প্রাণীরা কি মানুষের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা সরবরাহ করতে পারবে?
প্রাচীন যুগে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগামবার্তা পেতে প্রাণীদের আচরন লক্ষ্য করা হতো । গ্রীক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের তথ্যানুযায়ী, হেলিস শহরে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানার আগে এখান থেকে সব ইঁদুর, কুকুর, সাপ এবং বেজি পালিয়ে যায়। ১৮০৫ সালে নেপালে ভূমিকম্প আঘাত হানার কয়েকমিনিট আগে ষাড়, ভেড়া ,কুকুর সুউচ্চ স্বরে ডেকে সতর্ক করতে থাকে। অন্যদিকে ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ভূমিকম্পের কয়েকমিনিট আগে ঘোড়াগুলোকে দৌড়াতে দেখা যায়।
অনেক সময় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও অনেক ধরনের আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সতর্কবার্তা পাওয়া যায় না। যেমন, সিসমিক সেন্সরগুলো ভূপৃষ্ঠে ভূমিকম্প আঘাত হানার পরই কাঁপতে থাকে। নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস পাওয়ার জন্য শক্তিশালী সংকেত প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এমন কোন সতর্কবার্তা খোঁজে পান নি যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে অব্যাহতভাবে আমাদের জানান দিবে। তাই বিজ্ঞানীরা এখন পশুপ্রাণীর আচরনের মতো কিছু অপ্রচলিত সতর্কবার্তা পর্যালোচনার কথা ভাবছেন।
পরিযায়ী পাখিরা কিভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঝড় ও অন্যান্য প্রতিকূলতা এড়াতে সক্ষম হয় তা পরীক্ষা করে দেখতে কিভি কোয়াকা নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পটির সদস্য এবং ফ্রান্স বায়োডায়ভারসিটি অফিসের (ওএফবি) পাখি বিষয়ক দলের নেতা শ্যালর্ট ফ্রাঞ্চিয়াজ বলেছেন, ‘বর্তমান যুগে সবধরনের প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ার পরেও আমরা ভূমিকম্প অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস সঠিকভাবে পাই না।
প্রাণীরা কিভাবে দুর্যোগের আগামবার্তা পায় তা বোঝতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানটি হয়েছিলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। জার্মানির ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমেলর বিহেভিয়ারের মার্টিন ওয়েকেলস্কি এ অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। এই গবেষণায় মধ্য ইতালির ভূমিকম্পপ্রবন অঞ্চলের একটি খামারে গরু, ভেড়া এবং কুকুরের মতো বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর আচরন পরীক্ষা করা হয়। এখানকার প্রাণীদের গলায় একটি করে চিপ লাগিয়ে দেয়া হয়। এই চিপটি ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রিয় কম্পিউটারে প্রতি মিনিটে প্রাণীদের নড়াচড়ার তথ্য পাঠাতো। অফিসিয়াল পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, এই সময়ের মধ্যে অঞ্চলটিতে ১৮ হাজার বারের বেশি ভূমিকম্প হয়েছে। মাত্র দশমিক ৪ মাত্রার ভূকম্প থেকে ৪ মাত্রার ভূকম্পও ছিলো কয়েকডজন। এরমধ্যে ৬ দশমিক ৬ মাত্রার বিধ্বংসি নরসিয়ার ভূমিকম্পও ছিলো।
গবেষকরা দেখতে প্রমান পান যে প্রতিটি ভূমিকম্প আঘাত হানার কমপক্ষে ২০ ঘন্টা আগে খামারের প্রাণীদের আচরন পরিবর্তন হতে থাকে। পর্যবেক্ষণে রাখা খামারের প্রাণীগুলোকে ভূমিকম্পের ৪৫ মিনিট সময়ের আগে থেকে ৫০ শতাংশ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। আর এই প্রাণীদের আচরনের ওপর নির্ভর করে গবেষকরা চার মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা দিতে পেরেছিলেন। এছাড়া আটটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের সতর্কবার্তার সাতটিই সঠিক হয়েছিলো।
২০২০ সালে গবেষণাটি যখন প্রকাশিত হয় তখন ওয়েকেলস্কি বলেছিলেন, ‘ প্রাণীরা আসন্ন শকের যত কাছাকাছি ছিলো তাদের আচরন ততটাই পরিবর্তিত হচ্ছিলো। ’
দক্ষিণ আমেরিকায় আচরনগত পরিবেশবিদ রাচের গ্রান্টও গবেষনায় একইধরনের ফলাফল পেয়েছেন। ইয়ানাচাগা ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে চলমান ক্যামেরা ব্যবহার করে ভূমিকম্পের আভাস দিতে পেরেছিলেন।
ইতোমধ্যে অনেক দেশই প্রাণীর আচরন লক্ষ্য করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস পাওয়ার চেষ্টা করছে। চীন এরইমধ্যে একটি কোয়াক অ্যালার্ট সিস্টেম চালু করেছে। সাপের মতো মাটির কাছাকাছি থাকে এমন প্রাণীদের আচরন অনুসরন করে তারা দুর্যোগের আগাম বার্তা চাইছে। ন্যানিং ব্যুরোর পরিচালক জিয়াং ওয়েইসন বলেছেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে ভূমিকম্প নিয়ে সাপই সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রাণী। ভূমিকম্প আঘাত হানার আগে সাপেরা তাদের বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এমনকি শীতের সময়ও তারা এমন করে।’
তবে শুধুমাত্র ভূমিকম্পই নয় অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও প্রাণীরা আগে থেকেই টের পায়।
বিবিসি/আরএপি
আরও পড়ুন
যে পদ্ধতিতে রাস্তা বানানোয় টিকছে বেশিদিন!
এসএমএসে তিন দিন আগেই মিলবে বন্যার সতর্কতা
হাইড্রোজেনে ভর করে ৫৫ শতাংশ বেকারত্ব ঘুঁচাতে চায় নামিবিয়া