বিডিওএসএন'র কাজগুলোকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে চান সিইও কানিজ ফাতেমা

টেড-এক্স এ কানিজ ফাতেমা

সম্প্রতি বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন কানিজ ফাতেমা। নিজের কাজ, বিডিওএসএনে যোগদানসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন টেকশহর.কমের স্পেশাল করসপনডেন্ট নুরুন্নবী চৌধুরী’র সঙ্গে

২০০৫ সালের ২৪ অক্টোবর যাত্রা শুরুর পর থেকেই বিডিওএসএন দেশজুড়ে মুক্ত দর্শনের প্রচারের কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মুক্ত সোর্স সফটওয়্যারের ব্যবহার ও তথ্যাদি সবার মধ্যে জনপ্রিয়করণ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় ১৬ বছরের যাত্রা শেষে প্রথম বারের মতো সিইও হিসেবে কাজ শুরু করেছেন কানিজ ফাতেমা। তিনি জানালেন, ‘টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন ও রবির কমার্শিয়াল বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছি অনেকদিন। গ্রামীনফোনের আলো আসবেই-জিপির বিভিন্ন ইনোভেটিভ ইন্টারনেট প্যাকেজ, জিপি মোডেম ও ইন্টারনেট সিমকার্ড, জিপি কো-ব্র‍্যান্ডেড হ্যান্ডসেট ক্যাম্পেইন, রবি ইচ্ছেডানা প্যাক, অল্টারনেটিভ ক্রেডিট স্কোরিংয়ের মাধ্যমে রবি হ্যান্ডসেট লোন ক্যাম্পেইন, কৃষকদের জন্য বিশেষ মোবাইল প্যাক-রবি কৃষি ভাই ও ব্লক চেইনের মত বিভিন্ন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছি।’

এ কাজগুলোর স্বীকৃতিও মিলেছে। ২০১৮ সালে গ্রামীনফোন থেকে পেয়েছেন ‘মোস্ট কারেজিয়াস ফিমেল এমপ্লইয়ি’ পুরস্কার।  এছাড়াও এমার্জেন্সী টেলিকম সার্ভিস ইনোভেশন ইন রেসপন্স টু কোভিড-১৯ ক্যাটাগরীতে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য নিজের দুইটি প্রকল্প জিতেছে কমিউনিক এশিয়া পুরস্কার।

Techshohor Youtube

টেলিকম ছাড়াও বাংলাদেশ উইমেন-ইন-টেকনোলজির ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে গত তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালন করা কানিজ ফাতেমা কর্পোরেট খাতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে মেয়েদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ক্যারিয়ার গঠন ও এই খাতে নারী উদ্যোক্তা তৈরীতে সহযোগিতা প্রদান ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।  

টেকশহর: বিডিওএসএনের বর্তমান কাজগুলো সম্পর্কে বলুন।

কানিজ ফাতেমা: বিডিওএসএনের বর্তমানে বেশ কিছু কাজ চলছে। বিডিওএসএনের লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেখানে ওপেন সোর্স এবং ওপেন কন্টেন্টের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে স্বেচ্ছাসেবক এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের পেশাদাররা নিজেদের মত বিনিময় করতে পারবেন। নতুন ধরনের যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে। যা ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ জনবল তৈরিতে সহায়তা করবে।  বিগত বছরগুলোতে বিডিওএসএনের কাজগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিডিওএসএন তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বেশকিছু অবদান রেখেছে যা অনেকাংশে দৃশ্যমান। যার সুফল পাচ্ছে প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবহারকারীরা। নতুন দায়িত্বের অংশ হিসেবে এই সংগঠনের সব কার্যক্রমের সার্বিক প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বিশেষ ভুমিকা ও অবদান রাখতে চাই।

কানিজ ফাতেমা

টেকশহর: নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যুক্ত করাসহ  বর্তমানে বিডিওএসএনের কি কি কাজ চলছে?

কানিজ ফাতেমা: বর্তমানে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে নানা ভাবে যুক্ত করতে কাজ করছে বিডিওএসএন। কাজগুলোকে আরো এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম। তথ্যপ্রযুক্তিকে এই মুহূর্তে সরকার অগ্রাধিকার খাত বা থার্স্ট সেক্টর হিসেবে বিবেচনা করছে। দেশের আইসিটি খাতে নারীদের অন্তর্ভুক্তিতে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে বিডিওএসএন। সরকারের এই  লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নে সহযোগিতা করতে বিডিওএসএন তিন বছরের জন্য একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রকল্পটির নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যারা সক্রিয়ভাবে থাকতে চায় তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, পেশাদারিত্ব নিয়ে ক্যারিয়ার সচেতনতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্য খাতগুলোতে নিজেদের মেলে ধরা, যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। এখনও বাংলাদেশের কর্পোরেট অফিসসহ আইসিটি সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামুলকভাবে কম। বিডিওএসএন থেকে আমার চেষ্টা থাকবে এই সংখ্যাটাকে বৃদ্ধি করা এবং আমাদের কর্মসূচীগুলোকে আরও বেশি নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এর পাশাপাশি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে তথ্য- প্রযুক্তি খাতের ইতিবাচক দিকগুলোকে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব।

টেকশহর: দীর্ঘদিন ডিজিটাল সার্ভিস, টেলিকম, মিডিয়ায় কাজ করার অভিজ্ঞতাকে কিভাবে বিডিওএসএনের কাজগুলোতে ব্যবহার করতে চান?

কানিজ ফাতেমা: মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি যেটা শিখেছি, সেটা হলো দক্ষ কর্মী বাহিনী, সঠিক লক্ষ্যমাত্রা, কার্যকরী কর্মপদ্ধতি ও সঠিক লিডারশিপ একটি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারে। তাই আমার মূল লক্ষ্য থাকবে বিডিওএসএনের কর্মীদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও সেই সাথে বিদ্যমান কর্মপদ্ধতিগুলোকে আরো দ্রুততর ও কার্যকরী করে তোলা। ব্যাক্তিগতভাবে দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিডিওএসএন ও এর কাজগুলোকে ছড়িয়ে দিতে চাই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে দেশের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরীর উদ্দেশ্যে আগামী দিনগুলোতে আমরা সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে আরো বেশি বেশি ও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিতে চাই। যে প্রকল্পগুলোর নেতৃত্বে থাকবে উদ্যমী তরুণেরা।

টেকশহর: তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতির হার কেমন বলে মনে করেন?

কানিজ ফাতেমা: আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। অন্যান্য খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও ইদানীং নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এ খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান না হলে এবং নিজেদের দক্ষতার উন্নয়ন না করলে নারীরা ক্ষমতায়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে। ২০০৬ সালে আমাদের মোট শ্রমশক্তির ১৬ শতাংশ ছিল নারী। ২০১৯ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশ । ২০০৬ থেকে ২০১৯ সালে এসে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০ শতাংশ বেড়েছে। এ ২০ শতাংশ বাড়ার ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাত অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। মেয়েরা তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করে, কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক নেতৃত্বের দক্ষতা অনেকের মধ্যে কিছুটা কম। এটার জন্য তারা যে কম বুদ্ধিমান, বিষয়টি একেবারেই তা নয়। নারীরাও পুরুষদের মতই মেধাবী ও অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হয়। কিন্তু তাদের জন্য দরকার যথাযথ দিক নির্দেশনা ও সঠিক কর্মসংস্থানের সুযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমার মতে আগামীতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।

টেকশহর: ডিজিটাল অগ্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে আপনার নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা আছে?

কানিজ ফাতেমা: দেশের‍ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যেহেতু নারী, তাই সারা দেশের সব জায়গার সব মেয়েদের সার্বিক উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি ব্যতীত ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও এর অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য ছেলেদের পাশাপাশি আমাদের মেয়ে শিক্ষাত্রীদেরও তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়ে দক্ষ ও পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে বিডিওএসএন থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে থাকি।

উদাহরণ হিসেবে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়ার জরিনা রহিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা বলতে পারি। এই স্কুলে আমরা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটসুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের জন্য আমরা প্রোগ্রামিং, রোবোটিক্স, আইওটির বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। এই মেয়েদের মধ্য থেকে অনেকেই বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিডিওএসএন আওয়ার অব কোড ও বাংলাদেশ গার্লস কোডিং এর মত বিভিন্ন নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে যেগুলোর মাধ্যমে সারা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সব মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে । সেই সাথে তাদেরকে ইএসডিজি৪ বিডি প্রকল্পের সাহায্যে পরবর্তীতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ইন্টার্নশীপ থেকে শুরু করে পেশাগত জীবন শুরুর ক্ষেত্রে সহায়তা করা হবে।

*

*

আরও পড়ুন