![]() |
টেক শহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : ‘নকল হইতে সাবধান, আমরাই আদি ও আসল অ্যামাজন’-ভবিষ্যতে যদি এমন বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করেন ধন্ধে পড়ে যাবেন নিয়শ্চই!
ই-কমার্স গ্রাহক হিসেবে বিরক্তি নিয়ে হয়তো বলবেন, কীরে বাবা, অ্যামাজনের মতো বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স জায়ান্টেরও নকল কোম্পানি হয়ে গেছে এ দেশে!
বছরব্যাপী দেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তাদের কত অভিযানে কী পণ্য নেই যে তার নকল উদ্ধার করে না। ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, খাদ্যপণ্য, নাটবল্টু হতে শ্যাম্পু পর্যন্ত, এমন কি করোনার সময় স্যাভলনের নকল স্যালভন হয়ে যায়।
তাই বলে অ্যামাজন!
দেশের রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজে (আরজেসি) ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে। যার তালিকাভুক্ত নম্বর- সি-১৪৮৮৫৬। অ্যামাজন বাংলাদেশের নামে ওয়েবসাইটে ‘উই আর ওপেনিং সুন, গেট রেডি টু এক্সপেরিয়েন্স কোয়ালিটি শপিং অ্যান্ড ডেলিভারি’ ম্যাসেজে ডিজিটাল টাইমলাইন গণনা চলছে। রাজধানীতে নেয়া হয়েছে অফিস, যেখানে চলছে প্রস্তুতি।
একটু দাঁড়ান প্লিজ, ওয়াও বলার আগে জেনে নিন এই ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ’ কিন্তু অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জেফ বেজোসের নয়!
তাহলে?
‘অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও মালিকানা দাবি করছেন মো : আমান উল্লাহ চৌধুরী।
টেকশহরডটকমের প্রশ্নে যিনি একই সঙ্গে দুটি বিপরীত দাবি করছেন, এক. মূল অ্যামাজন (amazon.com) হতে তাকে বলা হয়েছে বাংলাদেশে অ্যামজন কান্ট্রি অফিস চালু করতে এবং যা যা বলা হয়েছে তা তা তিনি করেছেন। তিনি বাংলাদেশি ই-কমার্স উদ্যোক্তা যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্লাটফর্ম অ্যামাজনের উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন।
দুই. বাংলাদেশের আইনকানুন মেনে এটা তার নিজের কোম্পানি করেছেন। তাই তিনি ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেডের’ প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। এটা তার অ্যামাজন, এটা ওই অ্যামাজন (আসল) নয়।
মো : আমান উল্লাহ চৌধুরী টেকশহরডটকমকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি, প্রাথমিকভাবে যে যে কথাবার্তা হওয়া দরকার তার পরবর্তী স্টেপে আমরা আছি। আমরা অ্যাপস তৈরি করছি, আমরা অফিস নিয়েছি। আনুসঙ্গিক যে কাজগুলো আছে, মানে আমাদের ওরা যে (অ্যামাজন) টার্গেটগুলো দিয়েছে, সে টার্গেট অনুযায়ী আমাদের জয়েন্ট স্টকে রেজিস্ট্রেশন করতে বলেছে-মানে যা যা বলছে আমরা স্টেপ বাই স্টেপ করেছি।’
‘আমাদের ফেইসবুকেও কোনো পেইজ নেই, কোথাও কোনো অ্যাপসও নেই। কারও কাছ হতে একটা পয়সা আনবো বা দেবো বা প্রতারণা করবো- উই হ্যাভ নো ওয়ে, নো প্লাটফর্ম। আমি একজন উদ্যোক্তা, আমি অ্যামাজনকে বাংলাদেশে আনার চেস্টা করছি, এটা নিয়ে কাজ করছি। আমার অপরাধটা কোথায় ?’ বলছিলেন তিনি।
টেকশহরের প্রশ্ন ছিলো, অ্যামাজনের সঙ্গে আপনার যে আলোচনা বা তাদের পরামর্শে কার্যক্রম এগোনোর বিষয়গুলোর কোনো প্রমাণ কী রয়েছে আপনার কাছে ?
মো. আমান উল্লাহ চৌধুরী তা থাকার দাবি করে বলেন, ‘এখন তো এই বিষয়টা সিক্রেট ইস্যু।’
টেকশহরের প্রশ্নের এক পর্যায়ে তিনি এবার বলেন, ‘ওই(আসল) অ্যামাজন আর এই অ্যামাজন এক না। এটা আমার অ্যামাজন। আমি এটা ফার্ম করেছি । এটা আমার কোম্পানি। তার (আসল অ্যামাজনের) সঙ্গে মার্জ করতে পারি, চেষ্টা করছি। আমার আওতার মধ্যে আনতে পারি। কে না ভাল কিছু করতে চায়।’
‘সম্পূর্ণ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০২১ সালে চালু করার লক্ষ্য নিয়ে ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেড’ এর ওয়েবসাইট ও অ্যাপের নির্মাণ কাজ এখনও চলমান। দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অন্য সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মত করেই ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেড’ চলবে’ জানান তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মো. হাফিজুর রহমান টেকশহরডটকমকে বলেন, বিদেশী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান যদি এদেশে ব্যবসা করতে চায় বা বিনিয়োগ করতে চায় তাহলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডার অনুমতি নিয়ে জয়েন্ট স্টকে নিবন্ধন করে ব্যবসা করতে পারে।
‘বাংলাদেশে অ্যামাজন ব্যবসা করতে আসছে সেটা তারা জানেন না’ বলছিলেন ডব্লিউটিও মহাপরিচালক।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিচালক মো. আরিফুল হক টেকশহরডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গেলে জয়েন্ট স্টকে নিবন্ধন এবং বিডার অনুমতি লাগবে। এর বাইরে সুযোগ নেই।
‘বাংলাদেশে অ্যামাজনের ব্যবসা করার কোন তথ্যই বিডায় নেই, আমরা পাইনি কিছু’ বলছিলেন বিডার এই পরিচালক।
অ্যামজনের সঙ্গে পলিসি পর্যায় এবং বাংলাদেশে কার্যক্রমের প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক আগে হতেই নানাভাবে যুক্ত সরকারের এটুআইয়ের রুরাল ই-কমার্স এবং হেড অব কমার্সিয়ালাইজেশন (আইল্যাব) এর টিম লিড রেজওয়ানুল হক জামি।
তিনি বলছেন, ‘ গ্লোবাল অ্যামাজন বাংলাদেশে কান্ট্রি অফিস হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেছে এমন তথ্য তিনি জানেন না।’
ই-ক্যাব বলছে বাংলাদেশে কান্ট্রি অপারেশন হিসেবে অ্যামাজন আসার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল টেকশহরডটকমকে বলেন, ‘এসব ফ্রড কার্যক্রম। পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মানুষকে সাবধান হতে হবে, এদের সঙ্গে কোনো প্রকার লেনদেন করা যাবে না। ই-কমার্স এখন অনেক বড় হচ্ছে, অনেক সুযোগসন্ধানীরা এটা কাজে লাগাতে চাইবে।’
‘এদের বিরুদ্ধে স্ট্রং ব্যবস্থা নিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটা কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সেন্টার করার কথা হচ্ছে, সেখানে ভোক্তা অধিকারকে যুক্ত করা হচ্ছে। এসব কারণে আইন দরকার, আইন হয়ে গেলে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া যাবে’ বলছিলেন ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক।
দেশে ‘আসল’ অ্যামাজনের যে কার্যক্রম :
বাংলাদেশে অ্যামাজনের কান্ট্রি অফিস হিসেবে আসা নিয়ে আলোচনা-গুঞ্জন বেশ কয়েক বছর ধরেই। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দেশিয় ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যত রোডম্যাপ নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখা খাত সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় অ্যামাজন শতভাগ সরাসরি বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে আসছে এমন তথ্য আসে।
ওই বছরের শুরুতেই অ্যামাজনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ঘুরে যান। তখন ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করতে চান- এমন মতামতের কথা বলা হয় তখন।
ওই সময়ে বাংলাদেশে সফরকালে অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই), ব্যাংকিং খাত, বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠক-আলোচনা করে গেছেন বলে বলা হয়। তখন এটুআইয়ের সঙ্গে বৈঠকে অ্যামাজন সরকারের একশপ ই-কমার্স মার্কেটপ্লেসের অবকাঠামোগত সুবিধা চেয়েছিল আলোচনায় উল্লেখিত হয়।
কিন্তু ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে এক বৈঠকে ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, নিজেদের ওয়্যারহাউজগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য নিতে বিশেষ সুবিধা চায় অ্যামাজন।
যাতে স্থানীয় বিক্রেতা ও উদ্যোক্তারা সহজে অ্যামাজনের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করতে পারে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে ওই বৈঠকে অংশ নেন আমাজনের এক প্রতিনিধি দল। বৈঠকে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং অ্যামাজনের পক্ষে ছিলেন কোম্পানিটির ইন্টারন্যাশনাল এক্সপানশন বিভাগের ক্যাটাগরি ম্যানেজার গগন দিপ সাগর।
ওই বছরের আগস্টে ওয়ালটনের সঙ্গে চুক্তি করে অ্যামাজন। এতে প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওয়ালটনের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স বিক্রি হবে।
এছাড়া বাংলাদেশে আগে হতেই অ্যামাজনের অনেক বিক্রেতা রয়েছেন। যদিও এই সংখ্যা কতো তা জানা যায়নি। তবে এসব বিক্রেতার বেশিরভাগ বাংলাদেশ হতে অ্যামাজনে পণ্য না পাঠিয়ে চায়না বা অন্য কোনো দেশ হতে পণ্য কিনে সরাসরি ওখান হতেই অ্যামাজনের কাছে পাঠিয়ে দেন।
কোনো কোনো বিক্রেতা যারা বাংলাদেশ হতে পণ্য পাঠান তারা সংখ্যায় খুব কম। কারণ এখানে এলসি খোলা, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ, এনবিআর, কাস্টমসসহ ব্যাপক প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয় ওই বিক্রেতাকে।
আবার এই বিক্রেতাদের বিক্রয়সংক্রান্ত সেবাও দিয়ে থাকেন কেউ কেউ। এছাড়া অ্যামাজন বাংলাদেশের সেলারদের নিয়ে দেশে অনুষ্ঠানও করেছে।
এডি/২০২০/আগস্ট১২/১৭৪০
আরও পড়ুন –