![]() |
করোনার প্রভাবে দেশের প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায়ীরাও আছেন দুশ্চিন্তায়। খাতটির বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র সব পর্যায়েই কী ধরণের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ তা জানাতে টেকশহরের মুখোমুখি বিসিএসের সভাপতি মো. শাহিদ-উল-মুনীর। সাক্ষাতকারে আল-আমীন দেওয়ান।
টেক শহর : করোনা পরিস্থিতিতে দেশের আইটি পণ্য আমদানিকারক ও বিপণনকারীরা কী ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও সার্ভিস চালাতে পারছেন ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে চীনে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন এবং বিপণন কমতে শুরু করেছে। প্রযুক্তিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চীন নির্ভর ব্যবসার দুরাবস্থা দেশেও প্রভাব বিস্তার করে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর প্রযুক্তিপণ্য বিপণন এবং প্রদর্শনী কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি বন্ধ আছে। সে হিসেবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং সার্ভিস কার্যত বন্ধ রয়েছে।
টেক শহর : কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে যারা জরুরি আইটি সেবা নেয় যেমন, ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন আইটি সার্ভিস, হাসপাতালে ব্যবহৃত প্রযুক্তিপণ্যের সার্ভিস, ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সঙ্গে যুক্ত প্রযুক্তিপণ্যের সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবাগুলোর ক্ষেত্রে গ্রাহক রেসপন্স কীভাবে হচ্ছে ? অনেকক্ষেত্রেই ব্যক্তি পর্যায়েও আইটি সার্ভিস জরুরি হয়ে যায়, সেখানে কী হবে ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন আইটি সার্ভিস, হাসপাতালে ব্যবহৃত প্রযুক্তিপণ্যের সার্ভিস, ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সঙ্গে যুক্ত প্র্রযুক্তিপণ্যের সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এতে গ্রাহক এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান উভয়ই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই সেবাখাতগুলোতে গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জরুরি অবস্থার কারণে প্রয়োজনীয় সময় টেকনিশিয়ানরা যাতায়াত সুবিধা পাচ্ছেন না। দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকের এটিএম বুথ বিসিএস সদস্যদের প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে। তাই বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি এই খাতকে জরুরি খাত হিসেবে ঘোষণা করে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের চলাচল নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অনলাইনে যতটুকু সেবা দেয়া যায়, বাসায় বসে বিসিএস সদস্যরা এবং প্রযুক্তি ব্যবসায়ীরা সে সহযোগিতা উন্মুক্ত রেখেছেন।
টেক শহর : প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায়ীরা এই সেবা না দিতে পারলে এই দুর্যোগে এসব জরুরি ক্ষেত্রে কীভাবে সেবা মিলবে ? বিসিএস কোনো উদ্যোগ নিয়েছে? কোনো প্রস্তাব ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : হার্ডওয়্যার পণ্যের ক্ষেত্রে ইন্সটলেশন এবং সার্ভিসের ক্ষেত্রে দক্ষ লোকের প্রয়োজন হয়। শুধুমাত্র পণ্য সরবরাহকারী লোক দিয়ে এই সেবা দেয়া সম্ভব নয়। তাই জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে হলে এই খাতকে সরকারের তরফ থেকে জরুরি খাত হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ইতোমধ্যে এই খাতকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কাছে আবেদন জানিয়েছে। আশা করছি শিগগিরই আমরা ইতিবাচক সাড়া পাবো এবং এই খাতকে সচল রাখতে পারবো।
টেক শহর : বিসিএসের সদস্য প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসায়ী কতজন ? ঢাকার বাইরে এই সংখ্যা কত ? বিসিএসের সদস্য নন এমন প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসায়ীদের কোনো পরিসংখ্যান কী রয়েছে ? এরমধ্যে মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন কতজন ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির ২৩১১ জন সদস্যের মধ্যে ১৮০০ জন প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঢাকার বাইরে ৩৫০ জন প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসায়ী আমাদের সদস্য। বিসিএসের সদস্য নন এমন প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ীদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিসিএস সদস্যদের মধ্যে প্রায় ১৭০০ সদস্যই মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
টেক শহর : মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যারা একটি মার্কেটে দোকানভিত্তিক সরাসরি গ্রাহক সেবা দেন তাদের কী অবস্থা ? এখন তো সব মার্কেট বন্ধ রয়েছে।
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : জানুয়ারি থেকেই দেশে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। লকডাউনের পর প্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের অবস্থা শোচনীয়। বেচা-বিক্রি নেই বলে তাদের ব্যবসা এখন পুরোপুরি বন্ধ। কিন্তু প্রদর্শনীকেন্দ্র এবং গোডাউন ভাড়া, স্টাফদের বেতন, ব্যাংক ঋণ সবকিছুই তাদের পরিশোধ করে যেতে হচ্ছে। যা ব্যবসায়ীদের প্রযুক্তি ব্যবসা বন্ধের কারণ হিসেবেও দাঁড়াতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রণোদনা বা জামানতবিহীন ঋণ ছাড়া ব্যবসায় ফিরে আসা বেশ কঠিন।
টেক শহর : খুচরা পর্যায়ে যখন সকল বিকিকিনি বন্ধ রয়েছে তখন আমদানিকারক ও ডিস্ট্রিবিউটররা কী ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়ছেন ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : খুচরা পর্যায়ে বিকিকিনি বন্ধ হয়ে গেলে ডিস্ট্রিবিউটর এবং আমদানিকারক পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমদানিকারক এবং ডিস্ট্রিবিউটররা এখন বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন। তারল্য সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার উপর রয়েছে ব্যাংক ঋণের চাপ। বড় কোম্পানি হওয়ার কারণে তাদের খরচের পরিমাণও বেশি। তাই এইসময়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
টেক শহর : দেশে প্র্রযুক্তিপণ্যের চাহিদায় কেনো সংকট তৈরি হয়েছে ? হলে কী প্রভাব পড়তে পারে আর করণীয় কী এখন ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : প্রযুক্তিপণ্য বিপণন এবং প্রদর্শনী কেন্দ্র বন্ধ থাকায় গ্রাহক প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা প্রকাশ করতে পারছেন না। বেচাকেনা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা সংকট হবে কী না বলা যাচ্ছে না। যদি প্রভাব পড়ে সেসময় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে।
টেক শহর : এ খাতে কর্মরতদের চাকরি হারানোর কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : ব্যবসা নির্ভর করে বেচাবিক্রির উপর। বিক্রি কমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবসায়ীরা যোগান কমিয়ে দিবেন। সেক্ষেত্রে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর বেতন দেয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার লোক এই খাতে চাকরি করছেন। চলমান অবস্থা বিরাজমান থাকলে ৫০ শতাংশ লোকের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, এ খাতে কাজ করতে হলে দক্ষতার প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বিনিয়োগ করে যে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি করেছে তা এই খাতের উন্নয়নের জন্য একটি অতি আবশ্যকীয় উপাদান। ধারণা করা হচ্ছে, এ অবস্থা বিরাজমান থাকলে দক্ষ জনশক্তি হারানোর আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে ।
টেক শহর : তাহলে এই যে এত সংকট, এর মধ্যে খাতটির জন্য সংগঠন হিসেবে কী কী উদ্য্যোগ নিয়েছে বিসিএস ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : মহাসংকটময় এই সময়কে মোকাবেলা করার জন্য বিসিএস ইতোমধ্যে সরকারের কাছে অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের উদ্যোক্তাদের সাহস দিতে এই খাতে প্রণোদনার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনসহ প্রযুক্তি খাতে কর্মরতদের আগামী ৬ মাসের আংশিক বেতন দেয়াসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখতে কেবলমাত্র বেতন বাবদ ১৫৬০ কোটি টাকা অনুদান চেয়েছে বিসিএস। এছাড়া অফিস, শো-রুম ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ চাওয়া হয়েছে আরও ৩৭০ কোটি টাকা। সব মিলে ১৯৩০ কোটি টাকা অনুদান চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শুধুমাত্র হার্ডওয়্যার সেক্টরের জন্য ৫৬০ কোটি টাকা প্রণোদনার প্রস্তাবও দিয়েছে বিসিএস,বেসিস, আইএসপিএবি, বাক্য এবং ই-ক্যাব।
এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অনুদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে ৫ বছর মেয়াদী ২ শতাংশ সুদে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া প্রয়োজন। যে ঋণ গ্রহণের এক বছর পর থেকে শোধের সময় শুরু হবে।
টেক শহর : আপনারা সরকারের সহযোগিতা চাইছেন, সেটা কী ধরনের সহযোগিতা এবং কীভাবে করা হলে তা কার্যকর হবে ?
মো. শাহিদ-উল-মুনীর : সরকারের আন্তরিক ভূমিকা ব্যতীত প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলোর একক প্রচেষ্ঠায় এই ক্রান্তিকালে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জের বিষয় বটে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এই দুঃসময়ে সরকার আন্তরিক হয়ে প্রণোদনা এবং ঋণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করলে আমরা এই খাতকে আরও বেশি লাভজনক খাতে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হবো। তথ্যপ্রযুক্তি খাত দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময়ী একটি খাত। ভিশন ২০৪১ পূরণে আমরাই হবো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।