![]() |
কাজল আব্দুল্লাহ : স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পা দিলাম আমরা! ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে হাটারও প্রায় এক যুগ। কি অর্জন আমাদের বা কতটুকু পথ মাড়ালাম? আমাদের কি এখন পথিক বলা যায়? উত্তর বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ নামের যে সবুজ মাঠে বসে আমরা হাসছি, গাইছি সেটি পেতে পেরুতে হয়েছে টকটকে লাল সরোবর। মনে কি রেখেছি তাদের? সংরক্ষণ করেছি সঠিক ইতিহাস? প্রজন্মের সময় টিকটিক করে টিকটকেই চলে যাচ্ছে, সংরক্ষণের`সং’ টাই আছে।
এই উদাসীনতার সুযোগেই শুরু হয় ডিজইনফরমেশনের খেলা। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নজর সবসময় ইতিহাসের দিকে। সুযোগ পেলেই তারা পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বদলে দেয়, ইতিহাসের মূল দলিল নষ্ট করে ফেলে, আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালায়।
একটা ইনফরমেশনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দেয়া এবং প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকেই বলে ‘ডিজইনফরমেশন’। সঠিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ না করলেই ইতিহাসের গাছ বেয়ে ওঠে অপপ্রচারের আগাছা। ইতিহাস বেঁচে থাকে সংরক্ষণ আর চর্চায়। আর ইতিহাসকে যে আঁধারে সংরক্ষণ করে আধার দূর করা হয় সেটাই মূলত ‘আর্কাইভ’। শুরু থেকেই আমাদের আর্কাইভের প্রবণতা কম। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তেমন বদলায়নি তা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে কথা বলেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মিঠুন সাহার সাথে। তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের মোট দলিল সাড়ে তিন লাখেরও বেশি পৃষ্ঠার। তার কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে ১৫ খণ্ডে, আরো অনেক অংশ প্রকাশিত হয়নি যেগুলি হলে সেটি ৫০-৬০ খণ্ড হতো। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র বিভিন্ন সময়ে বিকৃত করে প্রকাশের অপচেষ্টা দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে গেলে হিমঘরে চলে যাওয়া এই দলিল ফিরিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই।
আর্কাইভের গুরুত্ব অনুধাবনে আমরা অনেক পিছিয়ে, বিশেষ করে সরকারি উদ্যোগ খুবই কম। তবে, লেখার প্রথম অংশ পড়ে কোন হতাশাবোধ আসলে কাটিয়ে ফেলুন। এখানেও আলোর মশাল হাতে এগিয়ে এসেছে তরুণেরা। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তারাই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছে অন্তর্জালে।
জাতীয় আরকাইভস্ ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর
প্রথমেই ঢুঁ মারলাম জাতীয় আরকাইভস্ ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে। ওয়েবসাইট মারফত শুধু জানা গেলো, তাদের সার্ভারে জমাকৃত নথি সাড়ে আটলাখের মতো। এর মধ্যে কতগুলি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত? এই প্রশ্নের তেমন কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সুজায়েত উল্যা। তিনি জানালেন, অফিসে গিয়ে হার্ড কপি না দেখে কিছু বলতে পারছি না। তিনি আরো জানালেন যে, তাদের ডিজিটালইজেশনের যে কাজগুলি হয়েছে সেগুলি এখনো পাবলিকলি অ্যাভেইলেবল না। তবে তাদের ইচ্ছা আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকাগুলি ডিজিটালি সংরক্ষণ করার।
সময় নষ্ট না করে গেলাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। এখানে পাওয়া যাবে থানা, জেলা, বিভাগভিত্তিক ও খেতাবভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং আলাদাভাবে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম ও বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও রয়েছে এতে। এছাড়া, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কিছু ভিডিও এবং সেক্টরভিত্তিক ইতিহাসসহ নানা তথ্য। তবে মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি লিংক কাজ করে না এবং নিয়মিত তথ্য হালনাগাদ করা হয় না।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ
তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি মূলত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট হলেও এই সংস্থার কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে দুষ্প্রাপ্য কিছু সংগ্রহ আছে। সরকারি আর্কাইভের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ভিডিও ফুটেজের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল সংগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের। এদের ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে ৩০টির বেশি দুর্লভ ভিডিও উন্মুক্ত করা আছে।
তবে আর্কাইভের সবচেয়ে দামী ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকার পরেও এদের ডিজিটালাইলেজন গতি বেশ ধীর। ২০১২ এর জুন থেকে এখন পর্যন্ত এই সংস্থার আর্কাইভকৃত আইটেমের সংখ্যা মাত্র ৬২২ টি। এর মধ্যে ফিল্ম থেকে ডিজিটাল ফরমেটে রূপান্তরিত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত প্রামান্যচিত্র/তথ্যচিত্রের মাত্র ৩৭টি এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর ধারণকৃত ফিল্ম থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত সংবাদচিত্রের তালিকা ৪২৫ টি।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যত ডিজিটাল আর্কাইভ আছে তার প্রায় সবই বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর
মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু এক সুতোয় গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর তথ্য ডিজিটালাইজ করার ক্ষেত্রে কি কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানতে চেয়েছিলাম জাদুঘরের কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম খানের কাছে। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৪৭ সাল থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত সকল তথ্যের ডিজিটালাইজেশন প্রায় শেষ পর্যায়ে। করোনা আঘাত না হানলে আগামী এপ্রিলেই এটি জনসাধরণের জন্য উন্মুক্ত করা যেতো। তিনি আরো বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নথিও তারা ডিজিটাইলজড করছেন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই মুজিব বর্ষের মধ্যেই এটি ওয়েবে পাওয়া যাবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাইট হলো বঙ্গবন্ধুঅনলাইন ডট অর্গ। এখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নানা ছবি, ভিডিও, বই, সাক্ষাতকার রয়েছে।
জেনোসাইড বাংলাদেশ ডট অর্গ
মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে ইন্টারনেটে ঢুঁ মারতে গিয়ে প্রথমেই খোঁজ পাই জেনোসাইড বাংলাদেশ ডট অর্গ সাইটটির। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে প্রথম সমৃদ্ধ সাইট। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই ওয়েব আর্কাইভটি গণহত্যা নিয়ে এক ডিজিটাল তথ্যের আধার।
এর অন্যতম উদ্যোক্তা ও কিউরেটর ব্লগার রেজওয়ান এক আলাপে আমাকে জানিয়েছেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা কয়েকজন বাংলাদেশি ব্লগার, কিভাবে অসীম ভালোবাসা নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজটি শুরু করেছিলেন ২০০৭ সালে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামি ও যুদ্ধপরাধীদের প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণগুলি একটি জায়গায় আনা।
প্রথিতযশা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, সেলিম সামাদ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মাহবুবুর রহমান জালাল এই উদ্যোগের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন।
গণহত্যা, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, আইনগত দলিল-দস্তাবেজ, অসংখ্য ছবি, ভিডিও, আর্টিকেল দিয়ে সাজানো সাইটটি আসলেই মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার দারুণ সমৃদ্ধ এক তথ্যভাণ্ডার। জেনোসাইড ডট অর্গের আগে বাংলাদেশের কোন সাইটেই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য, দলিল সাজানো ছিলো না।
আইসিএসএফ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী আন্তর্জাতিক ফোরামে ডিজিটাল অ্যাডভোকেসির সবচেয়ে বড় ভূমিকা এই আইসিএসএফ এর। International Crimes Strategy Forum বা আইসিএসএফ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালে। গুরুত্বপূর্ণ অনলাইন তথ্য ভান্ডারটি মূলত ইংরেজি ভাষায়।
এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার উপরে খুবই সমৃদ্ধ ই-লাইব্রেরি ও মিডিয়া আর্কাইভ রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা গবেষকদের জন্য এই সাইটটি একটি সোনার খনি। এখানে রয়েছে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের রায়ের পাশাপাশি, গুরুত্বপূর্ণ দলিল, প্রমাণ, ছবি ও ভিডিও ।
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট
মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটাল আর্কাইভ নিয়ে বলতে গেলে গুরুত্বের সাথে বলতে হয় মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের কথা। বেসরকারি উদ্যোগে করা এই সাইটটি এখনো পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ ডিজিটাল আর্কাইভ। কী নেই এতে?
মুক্তিযুদ্ধের দূর্লভ অনেক দলিল, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার পেপারকাটিং, দলিল, চিঠি, অডিও-ভিডিও, বইপত্র ও অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। সাইটটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তালিকা ও এ সংক্রান্ত দলিলপত্র, পত্রিকার আর্কাইভস যেখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশিত সকল সংখ্যা এবং পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের ১৮৮৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সকল কপির সংগ্রহ।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশী বিদেশী লেখকদের বইও পাওয়া যাবে ইংরেজি কনটেন্ট বিভাগে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার বই অনলাইনে বিনামূল্যে পড়া যাবে এখানে। আরো দেড় হাজার বই যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া, এই লাইব্রেরিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের উপর বিভিন্ন সময়ের হাজার খানেক প্রামাণ্যচিত্র, অডিও, ভিডিও ফুটেজ।
মুক্তিযুদ্ধের ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের হাই রেজুলেশান ছবি আছে ৫ হাজারের মতো। যেকোনো পাঠক/ গবেষক মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ব্যবহার করতে পারেন একদম বিনামূল্যে। অবাণিজ্যিক এবং স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত এই আর্কাইভের কাজ আগে শুরু হলেও অনলাইন পদচারণা শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। এর প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির হোসাইন ও চেয়ারম্যান শান্তা আনোয়ার।
সাব্বির হোসাইন অনেকটা ক্ষোভের সাথেই বললেন, আমরা গবেষণার জন্য বিনামূল্যে এই ডকুমেন্ট উন্মুক্ত করে দিয়েছি, কিন্তু, এই চলার পথে সহযোগিতার চেয়ে প্রতিবন্ধতাই বেশি পেয়েছি, অপমানিত হয়েছি। বর্তমানে সাইটটি আপগ্রেডের কাজ চলছে। সকল কনটেন্ট ২/১ মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে সাব্বির জানালেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর এটি। তবে, জাদুঘরের কার্যক্রম বেশ আগে শুরু হলেও এই জাদুঘর ডিজিটাল আর্কাইভিং এর দিকে নজর দিয়েছে বেশ পরে। এখন মুক্তিযুদ্ধের দিনভিত্তিক তথ্যের পাশাপাশি অনেক ছবি, ভিডিও যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইটে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা, ডকুমেন্ট, ওরাল হিস্ট্রি, অডিও ভিডিও ও ছবি স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইটের আর্কাইভ পাতায়। এটি প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হচ্ছে।
১৯৭১ গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও ট্রাস্ট
এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। এটি খুলনায় প্রতিষ্ঠিত। কথা হয় ট্রাস্টের সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চৌধুরী শহীদ কাদেরের সাথে। তিনি বলেন, খুলনায় প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর ও আর্কাইভ সারা বাংলাদেশের গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর, ও নির্যাতন কেন্দ্র জরিপ করে সেই তথ্য এলাকাভিত্তিক জিপিএস ম্যাপিং করছে। ইতিমধ্যে ৮টি জেলার তথ্য জিপিএস ম্যাপিং করা হয়েছে যেটি এই ঠিকানায় দেখা যাবে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ২০২১ সালের মধ্যে সারাদেশের গণহত্যার তথ্য তারা এই ম্যাপে আনতে পারবেন। জনাব চৌধুরী আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি গণহত্যা নিয়ে তারা গণহত্যা নির্ঘন্ট বই আকারে প্রকাশ করছেন, এ সংক্রান্ত দুষ্প্রাপ্য ছবি এবং পত্রিকা সংগ্রহ করেছেন যেগুলি ওয়েবে উন্মুক্ত করার কাজ চলছে।
যুদ্ধদলিল
‘আমাদের পরিচয় হোক মুক্তিযুদ্ধ’ এই স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু হয় করে ডিজিটাল আর্কাইভিং এর আরেকটি প্ল্যাটফর্ম যুদ্ধদলিল। এদের মূল উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে সারাদেশের তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।
যুদ্ধদলিলের খুলনা অঞ্চলের সাবেক সমন্বয়ক অপূর্ব দাশ জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র সংকলনের প্রকাশিত ১৫টি খণ্ড ইউনিকোডে কম্পাইল এবং ইংরেজি দলিলসমূহ বাংলায় অনুবাদ করে তা এই ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের চর্চার জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কমিটি করে তরুণরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বিনামূল্যে কম্পাইলেশন ও অনুবাদের অসাধ্য কাজটি করেছে। যেকেউ বিনামূল্যে এই দলিল পড়তে ও ডাউনলোড করতে পারবে। মুঠোফোনে সহজে ব্যবহারের জন্য রয়েছে যুদ্ধদলিলের অ্যাপ। অ্যাপটি মিলবে এই ঠিকানায়। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও চর্চায় যুদ্ধদলিলের এলাকাভিত্তিক নানা উদ্যোগ রয়েছে।
ফ্রিডম ইন দ্য এয়ার
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এবং মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের তত্ত্বাবধানে তৈরি মুক্তিযুদ্ধের অনলাইন সংগ্রহশালার নাম ফ্রিডম ইন দ্য এয়ার। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য তো বটেই, অনেক অডিও-ভিডিও আছে এই পোর্টালে। এই ওয়েবসাইটের ‘ওয়ার ক্যালেন্ডার’ বিভাগে পাওয়া যাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রতিদিনের ঘটনা । পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার।
উইকিপিডিয়া:
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উইকিপিডিয়ার বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবকেরা উইকিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও গণহত্যার ইতিহাস দারুণ দক্ষতায় লিপিবদ্ধ ও সমৃদ্ধ করেছেন বছরের পর বছর ধরে। উইকিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সার্চ দিলেই দারুণ সব আর্টিকেল পাবেন রেফারেন্সসহ। মূল নিবন্ধ পাবেন এই ঠিকানায় এবং ঘটনাপ্রবাহ পাবেন এই ঠিকানায়।
বিশ্বকোষ বাংলাপিডিয়াতে আছে মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক নিবন্ধ।
তরুণ লেখক ও গবেষক সালেক খোকন ’যুদ্ধাহতের ভাষ্য’ শিরোণামে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি ও সাক্ষাতকার লিপিবদ্ধ করে চলেছেন বিডিনিউজ ২৪ ডটকমে। ইতিমধ্যেই এই সিরিজের ৯৯ টি সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং ভালো একটি আর্কাইভে পরিণত হয়েছে।
প্রিয় ডটকম
গণহত্যা জাদুঘরের আগেই প্রিয় ডটকম শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের জিপিএস ম্যাপিং। এর নাম দেয়া হয় ‘মুক্তি পিন’। এ বিষয়ে কথা হয় প্রিয় ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জাকারিয়া স্বপনের সাথে। তিনি জানান, তারা মুক্তিপিনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০০ পয়েন্ট জিপিএস ম্যাপিং করেছেন এবং এটির কার্যক্রম চলছে তবে ভেরিফিকশন করতে সময় লাগছে তাদের।
জনাব স্বপন আরো জানান, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের যেসব স্থানে গিয়েছেন সেইসব এলাকার তথ্য ও জিপিএস ম্যাপিং করার জন্য তারা ‘মুজিব পিন’ নামে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন এবং আশা করছেন এটি মুজিব বর্ষের মধ্যেই শেষ করতে পারবেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও সচেতনতা নিয়ে টিকটক তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করছিলাম লেখার শেষ দিকে মনে হচ্ছে তা পুরোপুরি ঠিক নয়। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কিছু তরুণেরদের জন্য লেখাটিতে গতানুগতিক বাঙালি মানসিকতার পরিচয় দিয়ে সমালোচনাটা করতে পারলাম না।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের শুরুতে আমার সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা সেইসব নিজের তরুণ তুর্কিদের প্রতি, যারা তাদের পূর্বপুরুষদের রক্তের ঋণ শোধের পথে হেঁটেছে। আমরা তোমাদের ভুলবো না।
সবাইকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা।
লেখক : সাবেক প্রধান নির্বাহী, ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর।