![]() |
ইমরান হোসেন মিলন, টেক শহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : বিদেশি বিনিয়োগের এ প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে ই-কমার্স খাত যতটা এগিয়েছে, ততটা নেতিবাচক বার্তাও গেছে ক্রেতাদের কাছে।
টেকশহরডটকমের খােঁজ-খবরে উঠে এসেছে আরও অনেক কিছু।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিরন্তর অভিযোগে ভোক্তা অধিকারে অভিযোগের শীর্ষ নাম যেমন দারাজডটকম, তেমনি দেশে এ খাতে আধিপত্য ও সফলতাও অনেক তাদের।
শুধু ভােক্তা অধিকারে নয়, ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের সংগঠন ইক্যাবেও প্রতিদিন আসছে জালিয়াতি ও ঠকানোর অনেক অভিযোগ। এত কিছুর মধ্যেও অনলাইনে কেনাকাটা জনপ্রিয় করে গ্রাহক বাড়াতে দারাজের ভূমিকাও বেশ বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
চীনা ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবার বিনিয়োগ পাওয়া দারাজ সম্প্রতি দেশে পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে। গ্রাহকদের ধন্যবাদ জানিয়ে আরও ভালো কিছুর প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে আগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিটির বিশাল ছাড়ের চটকদার এসব অফারও বাঁকা চোখে দেখছেন অনেকে। এ অফার নিয়েও প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।
শুধু অভিযোগ ও সমালোচনার পাল্লাই যে ভারি তা কিন্তু নয়, দেশে অনলাইন গ্রাহকের একটি বড় শ্রেণি তৈরিতেও বড় ভূমিকা রেখেছে দারাজ বলে অভিমত খাত সংশ্লিষ্টদের।
তারা বলছেন, দেশব্যাপী নিজস্ব পণ্য ডেলিভারি হাব তৈরিতেও ভূমিকা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
ব্র্যান্ডটির দাবি, মাসে অন্তত ২০ লাখ গ্রাহকের অর্ডার আসে এবং তা সময়মত পৌঁছে দেওয়া হয়। এ জন্য দেশব্যাপী রয়েছে পিকআপ পয়েন্ট, যেখান থেকে ক্রেতারা পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
পাঁচ বছরে দারাজের এগিয়ে চলা এবং গ্রাহকদের নানামুখী অভিযোগ ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি ই-মেইলে বিভিন্ন অভিযোগ খন্ডন করেছে। জানিয়েছে দেশের ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে তাদের প্রচেষ্টার কথা। প্রতিবেদনের শেষ অংশে থাকছে সেই প্রশ্নোত্তর।
বড় হয়েছে কোম্পানি, বাড়েনি সেবার মান
সংশ্লিষ্টদের মতে, অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজার অংশীদারিত্বেরও উল্লেখযোগ্য অংশ ব্র্যান্ডটির দখলে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, দেশের সর্বত্র পণ্য পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যে নিজেদের লজিস্টিক সাপোর্ট তৈরি করেছে। দারাজ এক্সপ্রেস নামের ওই সেবার মাধ্যমে যথাসময়ে পণ্য পাচ্ছেন ক্রেতারা বলে দাবি তাদের।
এ ছাড়া তাদের প্লাটফর্মে শতাধিক ক্যাটেগরিতে এক কোটির বেশি পণ্য রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েক হাজার সেলার।
পরিমাণগত দিক থেকে বড় হলেও সেবার মান যে খুব বাড়েনি, তা ক্রেতাদের অভিযোগ দেখলেই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় অভিযোগ সময়মতো পণ্য না পৌঁছানোর।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ই-ক্যাব সব জায়গাতেই দারাজের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই।
খাত সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, ই-কমার্সের ইকোসিস্টেমে বিদেশি কোম্পানিটি অনলাইন গ্রাহকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবকে চাঙ্গা করেছে। তারা ক্রেতাদের সতর্কভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রির নীতিমালা দেখে-বুঝে পণ্য অর্ডারের আহ্বান জানান।
অভিযোগ আর অভিযোগ
পেমেন্ট করেছেন হেডফোনের, দারাজ পাঠিয়েছে ওটিজি কেবল-বলে অভিযোগ বদরুদ্দোজা মাহমুদ নামের এক ক্রেতার। অভিযোগের পর পিকআপ পয়েন্ট থেকে হেডফোন নিয়ে আসতে বাধ্য করা হয় তাকে। তাহলে আর অনলাইনের মাজেজা থাকল কি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ফেইসবুকে ‘ই-কমার্স রিভিউজ’ নামে জনপ্রিয় একটি গ্রুপ আছে। ক্রেতারা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এ গ্রুপে। সেখানে আব্দুল্লাহ আল মুকিত দারাজে অর্ডার করা বাইক নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
তার অভিযােগ বাইকের দামসহ ডেলিভারি চার্জ একবারে পরিশোধের পরও তার কাছ থেকে ডেলিভারি বাবদ এক হাজার টাকা দাবি করে দারাজ। কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয়, ‘আগে দারাজের নিয়ম অনুযায়ী ডেলিভারি দেওয়া হতো, এখন আলিবাবার নিয়ম আলাদা। তাই ম্যানুয়ালি ডেলিভারি চার্জ দিতে হবে!’
পরে মুকিতকে জানানো হয় ডেলিভারি চার্জ লাগবে না। যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে এক হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
আরেক ক্রেতা জাহিদুল ইসলাম গত ২৯ আগস্ট গ্রুপটিতে লেখেন, দারাজে অর্ডারের পর ডেলিভারি ম্যান বাসা পর্যন্ত আসতে অস্বীকৃতি জানান। বাধ্য হয়ে তার এলাকার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পণ্য সংগ্রহ করতে হয়।
এমনকি তার স্বাক্ষর না নিয়েই ডেলিভারি ম্যান চলে যান। কিন্তু পরে অনলাইনে পাঠানো রিসিভ পেপারে তার সই দেখে বিস্মিত জাহিদুলের প্রশ্ন, এটা কিভাবে সম্ভব। একই ঘটনায় দুটি অনিয়ম তাকে ক্ষুব্ধ করেছে।
একই দিনে গ্রুপে আরেকটি প্রতারণার অভিযোগ করেন মো. আকাশ। তিনি দারাজে যে ডিজাইনের পণ্য অর্ডার করেন, সেটি পাননি। পরে ফেরত দিতে চেয়েও পারেননি। অভিযোগের পর জানানো হয়, পণ্য ফেরত কিংবা রিফান্ড কোনটিই করা হবে না।
লিমন নামের এক ক্রেতা টেকশহরডটকমের কাছে ডেলিভারি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, দারাজে যতবার পণ্য অর্ডার করেছেন, কোনোবারই সঠিক সময়ে তা হাতে পাননি। সেবার মান বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সেই সময়ের রকেট ইন্টারনেটের ই-রিটেইল প্রতিষ্ঠান দারাজ ডটকম বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। তার আগে ২০১৪ সালের আগস্ট হতে তারা দেশে পরীক্ষামূলকভাবে তাদের কার্যক্রম চালায়।
আনুষ্ঠানিক যাত্রার কিছু দিনের মধ্যে সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ আসতে শুরু করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নকল পণ্য, পণ্য সরবরাহে প্রতারণা, নির্দিষ্ট পণ্য না দেওয়া, ভুল পণ্য দিয়ে সেটি ফেরত নিতে বা ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করা ইত্যাদি।
প্রতারণা
দারাজে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৮ প্লাস ফোন অর্ডার করেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের ভাকুড়া গ্রামের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন লিটন। তিনি ৬ এপ্রিল সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো প্যাকেট খোলার পর কাপড় কাঁচা সাবান দেখতে পান।
এটি সামাজিক মাধ্যমে চাউর হলে দারাজ কর্তৃপক্ষ বিবৃতিতে বলে, তারা প্যাকেটে ফোনই পাঠিয়েছিল; কিন্তু তৃতীয় কোনো পক্ষ সেটি বদলে ফেলেছে। পরে অবশ্য ওই গ্রাহককে ফােনটি আবার পাঠায় তারা।
লিমন নামের এক ক্রেতা টেকশহরডটকমকে সপ্তাহ তিনেক আগে দারাজ থেকে পণ্য কিনে ঠকার কথা জানান। তার অভিযােগ নষ্ট পণ্য গছিয়ে দেওয়ায় তিনি ফেরত পাঠান। তবে টাকা না দারাজ থেকে ভাউচার দেওয়া হয়। সেই ভাউচার দিয়ে কেনা পণ্যেও ভালো পড়েনি।
ওই ক্রেতা বলেন, দারাজ পাঁচ বছরে পা দেওয়া উপলক্ষে যে অফার দিয়েছে তাও অসঙ্গতিপূর্ণ। ৯৯ টাকার ডিলে ৯৯ টাকার পণ্য নেই।
প্রাইস ডাম্পিং
দারাজের বিরুদ্ধে সবসময়ই বড় অভিযোগ পণ্যের দাম বেশি লিখে ছাড়-অফারের ঘোষণা দেওয়া। এমনও দেখা গেছে, শোরুমে যে পণ্যের দাম ৪০ হাজার টাকা, সেটি দারাজে অনেক বেশি দাম লিখে বড় ছাড় দেওয়ার ঘােষণা দেওয়া হয়েছে। ছাড়ের পর শোরুম মূল্যের চেয়ে দাম বেশি।
গত মাসেও দারাজে ১২৫ টাকা দামের ওডমোস ক্রিম ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এমনকি ১০০ গ্রামের ওডমোস ক্রিম দাম বাড়িয়ে ৬০০ টাকায় বিক্রির বিজ্ঞাপনও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আবার ৩৩ শতাংশ ছাড় দিয়ে ৪০০ টাকায় বিক্রির ঘোষণাও এসেছে।
এক ক্রেতা টেকশহরডটকমকে জানান, মাস খানেক আগে তিনি দারাজ থেকে ১৪০ টাকা দিয়ে কানেক্টর কেনেন। কয়েক দিন পর রাজধানীর একটি মার্কেটে গিয়ে সেটির দর দেখতে পান ২৫ টাকা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে অভিযোগের শীর্ষে দারাজ
অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, অনলাইন কেনাকাটায় অধিদপ্তরে যত অভিযোগ সেগুলাের শীর্ষে রয়েছে দারাজ।
এক সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করে টেকশহরডটকমকে জানান, তারা ই-কমার্স, ফেইসবুক কমার্সসহ (এফ কমার্স) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ফেইসবুক পেইজের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এগুলোর মধ্যে দারাজের বিরুদ্ধে অভিযোগই বেশি।
আরেক কর্মকর্তা জানান, সংস্থার অভিযোগ সেল ছাড়াও কয়েকটি মাধ্যম হয়ে অভিযোগ পান তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্প থেকেও অভিযোগ আসে।
এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে দারাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে অধিদপ্তর। বড় অংকের জরিমানাসহ সতর্ক করা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ইক্যাবেও অভিযােগ
শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্লাটফর্ম দারাজের বিরুদ্ধে এ খাতের অন্য উদ্যোক্তাদের বড় অভিযােগ বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্টের। গত পাঁচ বছরে বেশ বড় আকারে কার্যক্রম শুরু করলেও ক্রেতাদের দিকটি থেকেছে উপেক্ষিত। তাদের কারণে দেশে অনলাইনে পণ্য কেনার মাধ্যমকে এখনও গ্রাহকরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন না।
অনেকে দারাজ থেকে প্রতিকার না পেয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাবে অভিযোগ করেছেন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল টেকশহরডটকমকে জানান, তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অভিযোগ ও পরামর্শ জানানো যায়। অভিযােগ পেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ই-মেইল করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
ঠিক কতগুলাে অভিযোগ এসেছে তা না জানালেও তমাল বলেন, দারাজ নিয়ে অনেক সময়ই অভিযোগ আসছে ইক্যাবে। সেগুলোর বিষয়ে ব্র্যান্ডটি ব্যবস্থাও নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইকোসিস্টেমে প্রভাব
দারাজ এখন বলতে গেলে পুরোটাই চীনা জায়ান্ট আলিবাবার নিয়ন্ত্রণে। এত বড় ব্র্যান্ড যুক্ত থাকার পরও অনলাইন কেনাকাটায় এত অভিযোগ কেন উঠছে?
বারবার একই রকম অভিযোগ পুরো খাতে কতটা প্রভাব ফেলে, এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুপরিচিত আরেক ব্র্যান্ড প্রিয়শপ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আশিকুল আলম খাঁন টেকশহরডটকমকে বলেন, অনলাইনে পণ্য কেনায় সামান্য নেতিবাচক কিছু পেলেই ক্রেতারা তা ছড়িয়ে দেন তার চারপাশে। সামাজিক মাধ্যমের দাপটের এ সময়ে তাই ক্ষতিটা অনেক। এ প্রভাব পড়ে পুরো ইকোসিস্টেমে।
আশিকুল বলেন, ক্রেতা শুধু নির্দিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করেন না; বরং অনলাইন কেনাকাটার বাজে অভিজ্ঞতার কথাই ঘুরেফিরে তুলে ধরেন।
তার মতে, উদ্যোক্তারা নিজেরা সতর্ক না হলে এবং গ্রাহকরা সচেতন না হলে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। তখন পুরো ইকোসিস্টেমকেই এর দায় নিতে হবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাসরুর টেকশহরডটকমকে বলেন, দেশে ই-কমার্স এখনও শৈশব পার করছে। ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হচ্ছে, দাঁড়াতে শিখছে। তাই অভিযোগ কিছু থাকবেই; কিন্তু সেটা যত কম হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দারাজ বাংলাদেশ ই-মেইলে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। প্রশ্নোত্তর আকারে তা তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন : দারাজের বিরুদ্ধে সময়মত পণ্য না পাবার অভিযোগই বেশি। আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?