![]() |
টেক শহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : সময় এখন প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে জীবন সহজ করার। সেই লক্ষ্যে কাজ করছে এআই ভিত্তিক উদ্যোগ সিগমাইন্ড। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ইমরান হোসেন মিলন।
বর্তমান সময়ে যে কয়েকটি প্রযুক্তি বিভিন্ন কাজে বেশি ব্যবহার হচ্ছে তার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্যতম। সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করতে উদ্যোক্তা হয়েছেন তানভীর তাবাসসুম অভি।
যেভাবে শুরু
সিগমাইন্ড নামের উদ্যোগটির শুরু বলতে গেলে ২০১৬ সালে। তখন অবশ্য আত্মপ্রকাশ না করলেও এর কাজ শুরু হয় তখনই। সে বছরই দেশে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলা হয়। বিষয়টি নিয়ে খুব নাড়া দেয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু আনাস ইবনে সামাদকে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। আবু আনাস তখন চিন্তা করতে থাকেন, কিভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও সুরক্ষিত করা যায়।
সহপাঠী সিয়াম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত কিভাবে করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। সেসময় তারা একসঙ্গে বসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ নিয়েও কাজ করেন। আর সেই কাজগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর।
গাড়িতে এআই ডিভাইস লাগিয়ে তার গতি পর্যবেক্ষণ করে চালককে সতর্ক করার প্রযুক্তি তৈরি করেন তারা। নাম দেন ‘অ্যাডভান্স ড্রাইভার অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যান্ড মনিটরিং সিস্টেম’ বা অ্যাডমস। সে বছর এমন প্রযুক্তির জন্য তারা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কানেক্টিং স্টার্টআপে সেরা পঁচিশে স্থান পায়। এরপর তাদের জায়গা দেওয়া হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে।
আর তখন থেকেই সিগমাইন্ড দলের সঙ্গে যুক্ত হোন তানভীর তাবাসসুম অভি। তিনি তখন জার্মানি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজিতে স্নাতক শেষ করেছেন। আর স্নাতক শেষের আগেই যোগ দিয়েছিলেন উড়োজাহাজ তৈরির প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসে। কিন্তু দেশে আশার ইচ্ছে তাকে কাজ ছাড়তে বাধ্য করে।
নিজেদের কাজের এবং চিন্তার সঙ্গে মিল দেখে তখন অভিকে সিগমাইন্ডে কাজ করার অফার করেন আবু আনাস এবং সিয়াম হোসেন। একটা সুযোগ পেয়ে অভিও চলে আসেন দেশে। কাজ করেন। আ হয়ে যান সিগমাইন্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আবু আনাস, সিয়াম, অভি ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটিতে শুরু থেকে আরেক সদস্য কাজ করছেন। তিনি আরিফ হোসেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করে প্রধান বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে সিগমাইন্ডে আছেন আরিফ।
কাজ করে এআই নিয়ে
অভি টেকশহরডটকমকে জানান, তাদের সফটওয়্যার মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক কম্পিউটার ভিশন টেকনোলজি যেকোনো সাধারণ সার্ভিলেন্স ক্যামেরাকে বুদ্ধিমান করবে। যেকোনো সাধারণ সার্ভিলেন্স ক্যামেরা এতে সংযুক্ত করলে বিভিন্ন বস্তু সনাক্ত করতে পারবে, মানুষের মুখমণ্ডল সনাক্ত করতে পারবে, গাড়ির লাইসেন্স প্লেট সনাক্ত করতে পারবে।
এছাড়া কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা শনাক্ত করতে পারবে এবং সঙ্গে সঙ্গে নোটিফিকেশন পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়, আমাদের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম হাইওয়েতে গাড়ির প্রকৃতি ও সংখ্যা গণনা, লেন ভায়োলেশন সনাক্তকরণ, গাড়ির গতি নির্ধারণ নম্বর প্লেট ক্যাপচারসহ স্মার্ট সিগন্যাল টাইমিং ম্যানেজমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
এছাড়া বর্তমানে আমাদের আরেকটি সফটওয়্যার ইন্টেলিজেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যা যেকোনো টোল প্লাজাতে স্থাপন করলে বাংলাদেশের ১০ রকম যানবাহন আলাদাভাবে সনাক্ত করে দ্রুততম সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায় করতে পারবে।
যেভাবে কাজ করে
আগের সফটওয়্যার মূলত যে কোনো সাধারণ আইপি ক্যামেরা সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলে আইপি ক্যামেরা থেকে আগত ভিডিও স্ট্রিম নিয়ে ফ্রেম বাই ফ্রেম এআই অ্যালগোরিদমের মধ্য দিয়ে প্রসেস করতে থাকবে। এই প্রসেসিং মূলত হয় ম্যাসিভ প্যারালাল কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে যা জিপিইউ নির্ভর।
প্রতিটি ফ্রেমে বিভিন্ন ধরনের অবজেক্ট-সাবজেক্ট যেমন, মানুষের মুখমণ্ডল গাড়ির নম্বর প্লেট বা গাড়ি ইত্যাদির অবস্থান সনাক্ত করার পরে সেই বিশেষ বস্তুটিকে আলাদা প্রসেসিং ব্যবস্থায় পাঠানো হয়, পরবর্তী পর্যায়ের সনাক্তকরণ যেমন, মুখমণ্ডল ডেটাবেজের থাকা মুখমণ্ডলের সঙ্গে ম্যাচ করানো, নম্বর প্লেটের অক্ষরগুলোকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা এবং পুনর্বিন্যাস করা ইত্যাদি।
এছাড়া প্রতিটা প্লেটের মধ্য দিয়ে প্রতিটা অবজেক্টকে আলাদাভাবে ট্র্যাকিং করা হচ্ছে, যা কোন বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন এবং গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে।
বিভিন্ন বস্তু সনাক্তকরণ এ আমরা ডিপ লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই বস্তুর অনেক গুলো ছবি দিয়ে মেশিনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যেন সে পরবর্তীতে এগুলোকে চিনতে পারে। এই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াটা অনেকটা মানব শিশুকে ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বস্তু চেনানোর মতই।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক স্টার্টআপ উদ্যোগ গ্রহণ করি তখন সবেমাত্র বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। সেই বিপ্লবে বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকেও অংশীদার হতে পেরে আমরা সত্যিই গর্বিত, বলেন অভি।
এছাড়া আমাদের দেশে তৈরি করা সফট্ওয়্যার প্রোডাক্টগুলো বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থায় ব্যবহার করা হচ্ছে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।
বর্তমানে আমরা কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স যেমন, ইন্টেলিজেন্ট এনভি এ সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে এনেছে যা প্রচলিত ডিভিআর বা এনভিআর সিস্টেমের চেয়ে অনেক উন্নত, যুগোপযোগী এবং সাশ্রয়ী। এটি আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, বলেন অভি।
বাংলাদেশ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ইচ্ছে আছে। সেজন্য কাজও শুরু হয়েছে। সেখানে আমাদের পার্টনার হিসেবে রয়েছে এনভিডিয়ার মত বিশ্বসেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।
বাধা ছিল
স্টার্টআপ মানেই বাধা। হাজার বাধা ডিঙিয়ে তবেই সফলতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছাতে হয়। অভি বলেন, প্রথমত বিষয়টি সেসময় আমাদের জন্যও খুব নতুন ছিল, ছিল না সঠিক গাইডেন্স, গ্রুমিং। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রতিষ্ঠিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা প্রাইভেট ইকুইটি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি, ফলে ফান্ডিং নিয়ে আমাদের একটা বাধা শুরু থেকেই ছিল।
তৃতীয় যেটা সবচেয়ে দুঃখজনক মনে হয়েছে সেটা হলো, বিদেশপ্রীতি। আমরা কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারের সময় সবসময় খুঁজি বিদেশী। আমরা দেশীয় সফটওয়্যার বা দেশীয় প্রযুক্তির চেয়ে বিদেশী প্রযুক্তি আনার দিকে একটু বেশি মনোযোগী। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম আমাদের লোকাল স্টার্টআপ কালচারকে দারুণভাবে নিরুৎসাহিত করে বলে জানান অভি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের চেয়েও বিশ্বমানের উদ্ভাবনী পণ্য তৈরি করা সম্ভব এটা হয়তো আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করি না, যার ফলে আমরা উদ্ভাবনী সৃজনশীল ভাবনায় পিছিয়ে পড়ছি। স্বদেশপ্রীতি কিন্তু ভারত চায়না রাশিয়া এরা নিজেদেরকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজেদের সুনাম ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে যতদিন আমরা নিজেরা নিজেদেরকে মূল্যায়িত করতে না পারবো নিজের মেধাকে মূল্যায়িত করতে না পারব ততদিন আমরা বিশ্ব পরিমন্ডলে অচ্ছুৎ থেকে যাব।
ব্যবহার হচ্ছে সিগমাইন্ডের পণ্য
বর্তমানে সিগমাইন্ডের তৈরি পণ্যগুলো বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, কামারখালী টোল প্লাজায় ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের এআই নির্ভর পণ্য।
অর্জন যতকিছু
২০১৬ সালে কানেক্টিং স্টার্টআপের মাধ্যমে উদ্যোগ হিসেবে সিগমাইন্ড সামনে আসে। এর পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো এনভিডিয়া ইনসেপশন প্রোগ্রামের মেম্বারশিপ লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭ সালেই সরকারের স্টার্টআপ বাংলাদেশ প্লাটফর্মে সেরা ২০ স্টার্টআপের মধ্যে জায়গা করে নেয় তারা। একই বছর বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেয় এবং অ্যাপিকটায় অংশ নেয়। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত স্টার্টআপ ভিলেজে বাংলাদেশ থেকে সিগমাইন্ড অংশ নেয়।
২০১৮ সালেই ভারতের মহারাষ্ট্রের একটি হাইওয়েতে সিগমাইন্ড ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরু করে। এছাড়াও চলতি বছর তুরস্কে অনুষ্ঠিত স্টার্টআপ ইস্তাম্বুল প্রতিযোগিতায় সেরা দশে জায়গা লাভ করে উদ্যোগটি।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক এন্টারপ্রেনারশিপ ওয়ার্ল্ড কাপে বাংলাদেশ রাউন্ডে শীর্ষস্থানে থেকেছে তারা। যা আগামী নভেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে বলে জানান অভি।
ইএইচ/ সেপ্টে ০৭/ ২০১৯/ ১৮৩০