বাংলাদেশের সামনে ফাইভজির চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি

আল-আমীন দেওয়ান, টেক শহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : এমন কিছু ঘটতে চলেছে যা হয়ত কল্পনাকেও হার মানাবে-ফাইভজি নিয়ে সারাবিশ্বের বিশেষজ্ঞদের এক কথায় পর্যবেক্ষণ এটা। বলা হচ্ছে, নতুন করে ভাবতে হতে পারে প্রচলিত আইন-কানুন, নগর পরিচালনা এমনকি রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়েও।

আসলেই কি এমন বিস্ময় ভাবনার কারণ আছে ?

ফাইভজির সময়ে নতুন এমন পৃথিবীর দেখা মিলবে যেখানে শুধু সকল মানুষ-মানুষে নয় বিশ্বের সব যন্ত্রপাতি-জিনিসপত্রও সবাই সবার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে।

Techshohor Youtube

গাড়ি সংযুক্ত রাস্তার সঙ্গে, চালকের ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে, ডাক্তাররা রোগীদের মেডিকেল ডিভাইসের সঙ্গে সংযুক্ত, অগমেন্টেড রিয়েলিটি মাধ্যমে যেকোনও সময় যেকোনও স্থানে থেকেই যা ইচ্ছে দেখে শুনে কিনে ফেলতে পারছেন, নতুন কিছু দেখে বা শুনে শিক্ষা নেয়ার কাজটিও সেরে ফেলছেন, বাসার দরজা-জানালা, ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিন, টিভি, এসি সব সব আপনার কমান্ড শুনছে। রাতারাতি দেখা গেলো রোবটের আরেক দুনিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

চলতি বছরেই ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদন বলা হয়, হাজার হাজার কোটি নিরাপদ সংযোগ তাৎক্ষণিকভাবে গড়তে পারবে ফাইভজি প্রযুক্তি। পরিবহন, স্বাস্থ্য, জরুরি সেবা, উৎপাদন ও বিতরণ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বড় প্রভাব ফেলবে এ প্রযুক্তি।

‘থ্রিজি বা ফোরজির চেয়ে ফাইভজি প্রযুক্তি বিশ্বকে বেশ বড়ভাবে নাড়া দেবে। বিদ্যুৎ বা পেট্রোলচালিত গাড়ির উদ্ভাবনের চেয়ে এটা কম বৈপ্লবিক হবে না। পুরো অর্থনীতির মোড় আর সামাজিক ব্যবস্থা পাল্টে ফেলার মত প্রযুক্তি এটি।’-উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

যদি এই হয় অবস্থা তখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ফাইভজি ইকোসিস্টেম কতটুকু তৈরি হবে এবং এমন পরিবর্তনের সঙ্গে কতটুকু খাপ খাওয়াতে পারবে ? যেখানে ২৫ জুলাই ফাইভজি প্রযুক্তির পরীক্ষা করে বাংলাদেশ বিশ্বের যে অল্প কয়েকটি দেশে এই পরীক্ষা হয়েছে সেই তালিকায় ঢুকে গেছে।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহরডটকমকে বলছিলেন, কোনো দেশে যখন ফাইভজি হবে তখন কিছু দিন পর দেখা যাবে লাখ লাখ গাড়ি চালক চাকরি হারিয়ে বসে আছে।

বিশ্বে এই প্রযুক্তিকে এক রকম ‘ভয়ংকর’ প্রযুক্তিই বলা হচ্ছে। কারণ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে এই প্রযুক্তি, তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে উল্টো নানা বিপদের মধ্যে পড়তে হবে -বলছিলেন মোস্তাফা জব্বার।

মোস্তাফা জব্বার বলছিলেন , ফাইভজির সঙ্গে যখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আওটি বা রোবোটিক্স কিংবা বিগ ডেটা এ রকম বিষয়গুলো একদম জড়িত হয়ে যাবে তখন আমাদের সমাজকাঠামো হতে প্রযুক্তিচিন্তার সঙ্গে এসবের সমন্বয় করতে না পারলে আমরা হুট করে এমন যুগে গিয়ে পড়ব যে যুগে খাপ খাওয়াতে পারবো না।

আমাদের ব্যাপক কাজ করার আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। যার শুরুটা এই ফাইভজি সামিট দিয়ে হলো-উল্লেখ করছিলেন তিনি।

সত্যিই এমন ভাবনার আছে । খ্যাতনামা কনসালটেন্সি ফার্ম ম্যাকিনসি গ্লোবাল ইন্সটিটিউট বলছে, রোবটের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ ৪৬ টি দেশের এই বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারাবে। এতে পুরো বিশ্বজুড়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ চাকরিজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আর ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষের চাকরি দখল করে নেবে রোবট।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ফাইভজির প্রভাবে আসা নতুন পণ্য ও সেবার মূল্য হবে ১২ লাখ কোটি ডলার। নতুন ওই অর্থনীতিতে দ্রুত ঢুকে পড়ার প্রবল তাড়াও থাকবে বাংলাদেশের।

এবার দেখা যাক ফাইভজি নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো।

দেশের অন্যতম দুটি মোবাইল ফোন অপারেটরের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী বলছেন, তাদের বেইজগুলোর মধ্যে ফোরজি হ্যান্ডসেট পেনিট্রেশন হচ্ছে ৮ বা ৯ শতাংশ। সেখানে হ্যান্ডসেট একটি চ্যালেঞ্জ।

তারা বলছেন, হ্যান্ডসেটের বর্তমান দাম বিবেচনা করলে এই ৮-৯ শতাংশ পেনিট্রেশন বেড়ে ২৫-৩০ শতাংশে যেতে ৪-৫ বছর লেগে যাবে।

এখন তাহলে এই হ্যান্ডসেট কোথা হতে আসবে। ফাইভজি চালু করতে গেলে তো এর ডিভাইস লাগবে। এটা ২৫-৩০ শতাংশ না হোক অন্তত ফোরজি মতো এই ৮-৯ শতাংশ তো হতে হবে-এমনটাই বলছিলেন ঐ দুই কর্মকর্তা।

অপারেটরগুলো বলছে, ফাইভজি নিয়ে গ্রাহক কী করবে? একজন গ্রাহককে এক বা দুই জিবিপিএস গতি দেয়া হলে ঐ গ্রাহকের ব্যবহারের জায়গা বা প্রেক্ষাটপগুলো কোথায় কোথায়? বাজারে গ্রাহকরাও তৈরি কতটুকু তৈরি হবে সেটাও একটা বিষয়। বিষয়টি ওই ইকোসিস্টেমেরই।

ধরা যাক শুরুতে দেশে খুব ম্যাসিভ স্কেলে নয় লিমিটেড স্কেলে ফাইভজি চালু করা হবে। এখন ফাইভজির গতির সঙ্গে স্পেক্ট্রাম সরাসরি সম্পর্কিত। তখন অপারেটরগুলোর হাতে ব্যাপক স্পেক্ট্রাম থাকার বিষয় আসবে। এখন এই স্পেক্ট্রাম কোথা হতে আসবে, কী দামে দেয়া হবে ?

দেশে ফাইভজি পরীক্ষার দিন এক উপস্থাপনায় জিএসএমএর সাউথ এশিয়া রিজিয়নের স্পেক্ট্রাম অ্যান্ড পলিসি বিষয়ক উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক নিতিন সাপ্রা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের মতো বিশাল জনসংখ্যার এমন দেশে ব্যবহারকারীদের কাছে সঠিক সেবা দিতে যথেষ্ট পরিমান স্পেকট্রাম প্রয়োজন।

‘জিএসএমএর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শেষ পর্যন্ত দেশে আছে ১৪ কোটি ৫০ লাখ ব্যবহারকারী, যার মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ ইউনিক। এই পার্থক্যের কারণ একই ব্যবহারকারী একাধিক সিম ব্যবহার করছেন। এর অর্থ, এই ইন্ডাস্ট্রির আরও স্পেকট্রাম দরকার নতুন ব্যবহারকারীদের কাছে সেবা দিতে।‘-বলছিলেন নিতিন।

জিএসএমের এই কর্মকর্তা জানান, ব্যবহারকারী প্রতি আয়ে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই খারাপ। ২৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩৭। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হলেও তারা মোবাইল সেবায় খরচ করেন কম।

ফাইভজির জন্য এটা বিনিয়োগ ভবিষ্যতের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ।

অপারেটরগুলোর ইক্যুপমেন্ট পার্সপেক্টিভ হতে ফাইভজি একটি ম্যাসিভ ইনভেসমেন্ট। এখন যদি ব্যবহারকারীর হিসাব করে এখনই সারাদেশে ফাইভজি করার দরকার নেই পরিকল্পনায় শুরু করা হয় তখন হয় বিনিয়োগটা কমানো সম্ভব।

দেশে সবেমাত্র ফোরজি সেবা শুরু হয়েছে। সেবাটি এখন প্রসার হচ্ছে। আগামী কয়েক বছর এর কাজ চলতে থাকে । যখন ফাইভজি সেবা চালু হবে তখন কয়েক বছর পর্যন্ত দুটি সেবা একত্রে কাজ করবে। তবে ফাইভজির অগ্রগতি অনেক বছর পর্যন্ত চলবে।

ওয়ার্ল্ড রেডিও কমিউনিকেশন কনফারেন্স বা ডব্লিউআরসিতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো আগামী এক যুগ পর্যন্ত ফাইভজি উন্নয়নে কাজ করবে। ২০১৯ সালের শেষে ডব্লিউআরসি সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার ফাইভজির কোন ব্যান্ড নিয়ে কি পলিসি নেবে তার ওপর অনেকটাই ফাইভজি স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন নির্ভর করবে।

স্পেকট্রাম হারমোনাইজেশন খুবই প্রয়োজন। এর ফলে ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস খরচ কমে আসে। আর তার চেয়েও গুরত্বপূর্ণ বর্ডার এলাকায় দুটি দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে সংঘর্ষ হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিষয়টি খুবই গুরত্বপূর্ণ।

ডব্লিউআরসিতে আইএমটি ব্যান্ড দেখভাল করার জন্য এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি বা এপিটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত মার্চে অনুষ্ঠিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি বা এপিজি মিটিংয়ে সকল দেশের থেকে প্রাথমিকভাবে ফাইভজির ব্যান্ডের রিভিউ পাওয়া গেছে। দেশগুলো কোন ব্যান্ড নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী তা তুলে ধরেছে। এপিটি মেম্বার সম্মেলনে বাংলাদেশ ২৬ ও ৩২ গিগাহার্জ ব্যান্ডের কথা বলেছে, যদি পরীক্ষায় সেগুলো ব্যবহারে কোনো বাধা না পাওয়া যায়।

জিএসএমের ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, বাংলাদেশ সরকারকে ডব্লিউআরসি-১৯ সম্মেলনে ৩ দশমিক ৫ ও ২৬ থেকে ২৮ এবং ৪০ গিগাহার্জ ব্যান্ডের বিষয়ে জোর দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করাটা জরুরি।

তিনি বলছেন, প্রযুক্তিগত নিউট্রালিটি অর্থাৎ একই স্পেকট্রাম একাধিক সেবায় ব্যবহার করার পলিসি নিয়ে বাংলাদেশ প্রশংসিত। সেটি ফাইভজির ক্ষেত্রেও ধরে রাখতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী ফাইভজি বিনিয়োগের জন্য অর্থনীতি ধরে রাখতে হবে বাংলাদেশের। আর এটা যে বেশ চ্যালেঞ্জেরই হবে।

তারা বলছেন,  সত্যিকার অর্থে ফাইভজির চালুর অনেকটাই নির্ভর করবে সরকারের পলিসি খাত সংশ্লিষ্টদের প্রতি কতটুকু উদার হচ্ছে তার ওপর।

আর এখন পর্যন্ত যা দৃশ্যমান তাতে সরকার তার ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে সবকিছু করতে উদারহস্ত।

*

*

আরও পড়ুন