![]() |
কামাল হোসেন, সিনিয়র লেকচারার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় : ইউরোপীয় ইউনিয়ন জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন-জিডিপিআর গত ২৫ মে থেকে কার্যকর করেছে।
এ রেগুলেশনের মূল উদ্দেশ্য এ জোটের দেশগুলোর নাগরিকদের একটি বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেছে। এর আওতায় ব্যক্তিগত তথ্যকে সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পেয়েছেন নাগরিকরা। এখন লক্ষ্য করার বিষয় হলো, বাংলাদেশ ও ইইউ‘র মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় নতুন এ আইনের কোনো প্রভাব আমাদের উপর পরবে কিনা।
শুরুতেই বুঝে নেওয়া যাক জিডিপিআর আসলে কী? এ আইন হলো- একটি তথ্য ও উপাত্ত সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ বিধি, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউর নাগরিকদের উন্নত স্তরের নিরাপত্তা দেয়। এর মাধ্যমে তারা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বারা কীভাবে সংগৃহীত ও ব্যবহৃত হচ্ছে সে সম্পর্কে জানবার অধিকার লাভ করে।
এ নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, ইইউ’র নাগরিকরা এখন চাইলেই তাদের কাছ থেকে নেওয়া ব্যক্তিগত তথ্যের ডাটাবেইজে ঢকুতে পারবে এমনকি এক সঙ্গে সব তথ্য মুছে ফেলতে পারবে। তাই এখন থেকে যে কোনও কোম্পানিকে ইইউ‘র নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের আগে বর্তমান নীতি পরিবর্তন করে গ্রাহকদের তথ্য নিয়ন্ত্রণের বর্ধিত অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন মূলত জিডিপিআর নিয়ে কাজ শুরু করে ১৯৯৫ সালে এবং সম্প্রতি তারা এটিকে কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছে।
তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়নে এখন ডিজিটাল বিশ্ব গড়ে উঠছে। এই যুগে মানুষ ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ই–মেইল, ম্যাসেঞ্জার অ্যাপস, আইওটিসহ আরও অনেক অত্যাধুনিক ফিচারের মাধ্যমে। এ সব যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্ভাবক গুগল, ফেইসবুক, মাইক্রোসফট, ইয়াহুর মতো কোম্পানিগুলো নতুন জিডিপিআরের চাহিদাগুলোকে আয়ত্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
এর কারণ তারা ইইউ‘র বাজার হারাতে চায় না, তাদের বর্তমান গ্রাহকদের সেবাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাখতে পারে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশের ব্যবহারকারীরাও যাতে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে সে চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আপনি জিমেইল, ফেইসবুক বা ইয়াহু মেইল ব্যবহার করে থাকলে সম্ভবত তাদের কাছ থেকে নীতি পরিবর্তন ও নতুন সংস্করণ সম্পর্কিত ই–মেইল পেয়েছেন।
এখন আসা যাক বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর কথায়। তাদেরও কি একই রকম পরিবর্তন আনতে হবে? তথা, জিডিপিআর কি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ হবে?
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে ইইউ অন্যতম। তাই আমাদের ওপরও অবশ্যই এটি প্রয়োগ হবে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চালাতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্য আদান–প্রদান যেমন হয়েছে, তেমনি সংরক্ষণ করা হয়েছে ই–মেইল, ফোন কল, ভিডিও কনফারেন্সিং, ডকুমেন্ট ইত্যাদি।
অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও সেবা আদান-প্রদানের মতো ইইউর অনেক দেশকে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং-বিপিও সেবা দেয় বাংলাদেশ। ডাটাসফট, ব্রেইন স্টেশন ২৩, ড্রিম ৭১- এর মতো বিপিও কোম্পানির সেবার তালিকায় যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড রয়েছে ইইউর শীর্ষ ১৫ রপ্তানি গন্তব্যের তালিকায়।
ইইউ’র বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে আমাদের কোম্পানিগুলো নিয়মিত কাজ করে। এতে অংশীদারদের মধ্যে অনেক ধরনের তথ্য বিনিময় হয়ে থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট সব কোম্পানি এবং একই সঙ্গে আরও অনেক কোম্পানি যেমন- টাস্কইটার, জেনেক্স, ইনফোসিস, ডিজিকন টেকনোলজিস, সিনটেক সলিউশনসও জিডিপিআর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
আর ইইউ‘র গ্রাহক খুঁজতে কিংবা তাদের কাছে পৌঁছানোর একটি অত্যাবশ্যক কৌশলগত মাধ্যম হলো ডিজিটাল মার্কেটিং। সম্ভাব্য গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ করে এ উপায়ে পণ্য বা সেবা বিক্রির চেষ্টা চালানো হয়। তবে জিডিপিআর ইইউ‘র নাগরিকদের যথাযথ সম্মতি ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত বা সংস্থাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ করে। এতে করে নতুন গ্রাহকের খোঁজ পাওয়া বা সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর বিষয়টা আগের মতো সহজ থাকছে না। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজে ছন্দপতন ঘটেছে।
নতুন এ আইনের কারণে কোম্পানিগুলো সব তথ্যের সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করবে এবং ফেইসবুকের ক্যামব্রিজ এনালেটিকা স্ক্যান্ডালের মতো অবৈধ কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে তা সুনিশ্চিত করবে। কোনোভাবে এ আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশেসহ বিশ্বের যে কোনও কোম্পানিকে সর্বোচ্চ দুই কোটি ইউরো কিংবা কোম্পানির মোট আয়ের ৪ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। এ জরিমানা এড়ানোর জন্য অবশ্যই নিয়ম-কানুন চলতে হবে।
এতে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব পরবে। কারণ কোম্পানিগুলোর জন্য ইইউ‘র নাগরিকদের তথ্য অ্যাক্সেস করে যথাযথ অনলাইন বিজ্ঞাপন তৈরি করা সত্যি অনেক কঠিন হবে। ই–মেইল মার্কেটিং পরিচালকরা আর ‘সার্বজনীন’ ই–মেইল প্রচারণা তাদের বর্তমান ও সম্ভাব্য গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যবহার করতে পারবে না। এর পরিবর্তে, ই–মেইলের মাধ্যমে তাদের ব্র্যান্ডগুলো প্রচার করার আগে প্রতিটি ব্যক্তির সম্মতি নিতে হবে। ফলে কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং ডাটাবেস অবশ্যই কমবে এবং সম্ভাব্য অনেক গ্রাহক হারাবে।
দেশের ক্রমবর্ধমান এসএমই বিপিও কোম্পানি বাইটোমাইনরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়মা ইসলামের সঙ্গে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়। এ কোম্পানির টার্গেট মার্কেট যুক্তরাজ্য। তিনি নতুন আইনের প্রভাব পড়ার বিষয়ে এতমত পোষণ করে বলেন, অচিরেই সেবা রফতানির কাজে জিডিপিআর অন্যতম নেতিবাচক উপাদান হিসেবে দেখা দেবে। সম্ভাব্য গ্রাহকদের ই–মেইল পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হলে কাজ পাওয়ার সুযোগ কমবে। তবে তিনি পুরোপুরি হতাশ না হয়ে জিডিপিআরের ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন। তার মতে, তাদের টার্গেট মার্কেট আগের তুলনায় ছোট ও বেশি ব্যক্তিগত হবে। এতে গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর ও দৃঢ় হবে, যা প্রত্যাশিত সাফল্যকে ফলপ্রসূ করবে।
বিপিও কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন ই–কমার্স কোম্পানি যুক্তরাজ্যেসহ ইইউর অনেক গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করে। এ জন্য গ্রাহকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। জিডিপিআর কার্যকর হওয়ায় এখন থেকে কোম্পানিগুলোকে নীতি পরিবর্তন করতে হবে এবং কোনও প্রকার চুক্তি লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে হবে, যাতে বিপুল আর্থিক জরিমানা প্রদানের দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।
জিডিপিআর কীভাবে আমাদের দেশে কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করবে, তা আরও বিস্তারিতভাবে শনাক্ত করতে ও বোঝার জন্য আরও গবেষণা করতে হবে। আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে জানতে চেয়েছি। অন্তত এটুকু নিশ্চিত, বাংলাদেশ ও ইইউ’র মাঝের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি অবশ্যই আর আগের মতো থাকছে না।
লেখক : সিনিয়র লেকচারার, ই কমার্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, ব্র্যাক বিজনেস স্কুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া গবেষণায় সহকারী হিসেবে ছিলেন মিম খন্দকার ও মাইশা মায়মুনা। তারা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ বিভাগের শিক্ষার্থী।